• 00

    Days

  • 00

    Hours

  • 00

    Minutes

  • 00

    Seconds

Monday, August 30, 2021

বন-ভোজনের ব্যাপার
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

হাবুল সেন বলে যাচ্ছিল—পোলাও, ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা—

উস-উস শব্দে নোলার জল টানল টেনিদা: বলে যা-থামলি কেন? মুৰ্গ মুসল্লম, বিরিয়ানি পোলাও, মশলদা দোসে, চাউ-চাউ, সামি কাবাব—

এবার আমাকে কিছু বলতে হয়। আমি জুড়ে দিলাম: আলু ভাজা, শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি, কুমড়ের ছোকা—

টেনিদা আর বলতে দিলে না! গাঁক-গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল: থাম প্যালা, থাম বলছি। শুক্তো—বাটি-চচ্চড়ি। —দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তার চেয়ে বল না হিঞ্চে সেদ্ধ, গাঁদাল আর শিঙিমাছের ঝোল! পালা-জ্বরে ভুগিস আর বাসক-পাতার রস খাস, এর চাইতে বেশি বুদ্ধি আর কী হবে তোর। দিব্যি অ্যায়সা অ্যায়সা মোগলাই খানার কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে ধাঁ করে নিয়ে এল বাটি-চচ্চড়ি আর বিউলির ডাল! ধ্যাত্তোর!

ক্যাবলা বললে, পশ্চিমে কুঁদরুর তরকারি দিয়ে ঠেকুয়া খায়। বেশ লাগে।

—বেশ লাগে?—টেনিদা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল: কাঁচা লঙ্কা আর ছোলার ছাতু আরও ভালো লাগে না? তবে তাই খা-গে যা। তোদের মতো উলুকের সঙ্গে পিকনিকের আলোচনাও ঝকমারি।

হাবুল সেন বললে, আহা-হা চৈইত্যা যাইত্যাছ কেন? পোলাপানে কয়—

—পোলাপান! এই গাড়লগুলোকে জলপান করলে তবে রাগ যায়! তাও কি খাওয়া যাবে এগুলোকে? নিম-নিসিন্দের চেয়েও অখাদ্য! এই রইল তোদের পিকনিক—আমি চললাম! তোরা ছোলার ছাতু আর কাঁচা লঙ্কার পিণ্ডি গোল গে—আমি ওসবের মধ্যে নেই!

সত্যিই চলে যায় দেখছি! আর দলপতি চলে যাওয়া মানেই আমরা একেবারে অনাথ! আমি টেনিদার হাত চেপে ধরলাম: আহা, বোসো না। একটা প্ল্যান-ট্যান হােক। ঠাট্টাও বোঝা না।

টেনিদা গজগজ করতে লাগল। ঠাট্টা! কুমড়োর ছােক্কা আর কুদরুর তরকারি নিয়ে ওসব বিচ্ছিরি ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না।

—না—না, ওসব কথার কথা!—হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় বোঝাতে লাগল। মোগলাই খানা না হইলে আর পিকনিক হইল কী?

—তবে লিস্টি কর—টেনিদা নড়ে-চড়ে বসল।

প্ৰথমে যে লিস্টটা হল তা এইরকম:

বিরিয়ানি পোলাও

কোর্মা

কোপ্তা

কাবার দু-রকম

মাছের চাপ—

মাঝখানে বেরসিকের মতো বাধা দিলে ক্যাবলা ; তাহলে বাবুর্চি চাই, একটা চাকর, একটা মোটর লরি, দুশো টাকা—

—দ্যাখ ক্যাবলা—টেনিদা ঘুষি বাগাতে চাইল।

আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাঁদা উঠেছে দশ টাকা ছ-আনা।

টেনিদা নাক চুলকে বললে, তাহলে একটু কম-সম করেই করা যাক। ট্যাক-খালির জমিদার সব—তোদের নিয়ে ভদ্দরলোকে পিকনিক করে!

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি দিয়েছ ছ-আনা, বাকি দশ টাকা গেছে আমাদের তিনজনের পকেট থেকে। কিন্তু বললেই গাঁট্টা। আর সে গাঁট্টা ঠাট্টার জিনিস নয়—জুতসই লাগলে স্রেফ গালপাট্টা উড়ে যাবে।

রফা করতে করতে শেষ পর্যন্ত লিস্টটা যা দাঁড়াল তা এই ;

খিচুড়ি (প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনিবে বলিয়াছে)

আলু ভাজা (ক্যাবলা ভাঁজিবে)

পোনা মাছের কালিয়া (প্যালা রাঁধিবে)

আমের আচার (হাবুল দিদিমার ঘর হইতে হাত-সাফাই করিবে)

রসগোল্লা, লেডিকেনি (ধারে ‘ম্যানেজ’ করিতে হইবে)

লিস্টি শুনে আমি হাঁড়িমুখ করে বললাম, ওর সঙ্গে আর-একটা আইটেম জুড়ে দে হাবুল। টেনিদা খাবে।

—হেঁ—হেঁ—প্যালার মগজে শুধু গোবর নেই, ছটাকখানেক ঘিলুও আছে দেখছি। বলেই টেনিদা আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে। ‘গেছি গেছি’ বলে লাফিয়ে উঠলাম আমি।

আমরা পটলডাঙার ছেলে—কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রোয়াকে বসে রোজ দু-বেলা আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় হাতি-গণ্ডার সাবাড় করে থাকি। তাই বেশ ডাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্রলোক! খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতো রাজকীয় খাওয়া!

—কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে শুনি? খুব যে চালিয়াতি করছিস, তুই ডিম পাড়বি নাকি?—টেনিদা জানতে চেয়েছিল।

—আমি পাড়তে যাব কোন দুঃখে? কী দায় আমার?—আমি মুখ ব্যাজার করে বলেছিলাম: হাঁসে পাড়বে।

—তা হলে সেই হাঁসের কাছ থেকে ডিম তোকেই আনতে হবে। যদি না আনিস, তা হলে—

তা হলে কী হবে বলবার দরকার ছিল না। কিন্তু কী গেরো বলো দেখি। কাল রবিবার-ভোরের গাড়িতেই আমরা বেরুব পিকনিকে। আজকের মধ্যেই রাজহাঁসের ডিম যোগাড় করতে না পারলে তো গেছি। পাড়ায় ভন্টাদের বাড়ি রাজহাঁস আছে গোটকয়েক। ডিম-টিমও তারা নিশ্চয় পড়ে। আমি ভন্টাকেই পাকড়লাম। কিন্তু কী খলিফা ছেলে ভন্টা! দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি আর ডজনখানেক ফুলুরি সাবড়ে তবে মুখ খুলল!

—ডিম দিতে পারি, তবে, নিজের হাতে বার করে নিতে হবে বাক্স থেকে।

—তুই দে না ভাই এনে। একটা আইসক্রিম খাওয়াব। ভন্টা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, নিজেরা পোলাও-মাংস সাঁটবেন। আর আমার বেলায় আইসক্রিম! ওতে চলবে না। ইচ্ছে হয় নিজে বের করে নাও—আমি বাবা ময়লা ঘাঁটতে পারব না। কী করি, রাজি হতে হল।

ভন্টা বললে, দুপুরবেলা আসিস। বাবা মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে। মা তখন ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোয়। সেই সময় ডিম বের করে দেব!

গেলাম দুপুরে। উঠোনের একপাশে কাঠের বাক্স—তার ভেতরে সার-সার খুপারি। গোটা-দুই হাঁস ভেতরে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। ভন্টা বললে, যা—নিয়ে আয়।

কিন্তু কাছে যেতেই বিতিকিচ্ছিরিভাবে ফ্যাঁস-ফ্যাঁস করে উঠল হাঁস দুটাে।

ফোঁস-ফোঁস করছে যে!

ভন্টা উৎসাহ দিলে: ডিম নিতে এসেছিস—একটু আপত্তি করবে না? তোর কোন ভয় নেই প্যালা—দে হাত ঢুকিয়ে।

হাত ঢুকিয়ে দেব? কিন্তু কী বিচ্ছিরি ময়লা!—ময়লা আর কী বদখত গন্ধ! একেবারে নাড়ি উলটে আসে। তার ওপরে যে-রকম ঠোঁট ফাঁক করে ভয় দেখাচ্ছে—

ভন্টা বললে, চিয়ার আপ প্যালা। লেগে যা!

যা থাকে কপালে বলে যেই হাত ঢুকিয়েছি—সঙ্গে সঙ্গে—ওরে বাপরে! খটাং দুইটা হাত কামড়ে ধরল। সে কী কামড়! হাঁই-মই করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

—কী হয়েছে রে ভন্টা, নীচে এত গোলমাল কিসের?—ভন্টার মা’র গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

আমি আর নেই। হ্যাঁচক টানে হাঁসের ঠোঁট থেকে হাত ছাড়িয়ে চোঁচা দৌড় লাগালাম। দরদর করে রক্ত পড়ছে তখন।

রাজহাঁস এমন রাজকীয় কামড় বসাতে পারে কে জানত। কিন্তু কী ফেরেববাজ ভন্টাটা। জেনে—শুনে ব্ৰাহ্মণের রক্তপাত ঘটাল। আচ্ছা—পিকনিকটা চুকে যাক—দেখে নেব তারপর। ওই পাঁঠার ঘুগনি আর ফুলুরির শোধ তুলে ছাড়ব।

কী করা যায়—গাঁটের পয়সা দিয়ে মাদ্রাজী ডিমই কিনতে হল গােটাকয়েক। পরদিন সকালে শ্যামবাজার ইস্টিশানে পৌঁছে দেখি, টেনিদা, ক্যাবলা আর হাবুল এর মধ্যেই মার্টিনের রেলগাড়িতে চেপে বসে আছে। সঙ্গে একরাশ হাঁড়ি-কলসি, চালের পুঁটলি, তেলের ভাঁড়। গাড়িতে গিয়ে উঠতে টেনিদা হাঁক ছাড়ল: এনেছিস রাজহাঁসের ডিম?

দুর্গা-নাম করতে করতে পুঁটলি খুলে দেখলাম।

—এর নাম রাজহাঁসের ডিম! ইয়ার্কি পেয়েছিস?—টেনিদা গাঁট্টা বাগাল।

আমি গাড়ির খােলা দরজার দিকে সরে গেলাম: মানে—ইয়ে, ছোট রাজহাঁস কিনা—

—ছোট রাজহাঁস! কী পেয়েছিস আমাকে শুনি? পাগল না পেটখারাপ?

হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও—ছাড়ান দাও। ডিম তো আনছে!

টেনিদা গর্জন করে বললে, ডিম এনেছে না কচু। এই তোকে বলে রাখছি প্যালা—ডিমের ডালনা থেকে তোর নাম কেটে দিলাম। এক টুকরো আলু পর্যন্ত নয়, একটু ঝোলাও নয়!

মন খারাপ করে আমি বসে রইলাম। ডিমের ডালনা আমি ভীষণ ভালোবাসি, তাই থেকেই আমাকে বাদ দেওয়া! আচ্ছা বেশ, খেয়ো তোমরা। এমন নজর দেব পেট ফুলে ঢোল হয়ে যাবে তোমাদের!

পিঁ করে বাঁশি বাজল—নড়ে উঠল মার্টিনের রেল। তারপর ধ্বস—ধ্বস ভোঁস ভোঁস করে এর রান্নাঘর, ওর ভাঁড়ার-ঘরের পাশ দিয়ে গাড়ি চলল।

টেনিদা বললে, বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে ইস্টিশান। তার মানে প্ৰায় এক ঘন্টার মামলা। লেডিকেনির হাড়িটা বের কর, ক্যাবলা।

ক্যাবলা বললে, এখুনি! তাহলে পৌছবার আগেই সে সাফ হয়ে যাবে?

টেনিদা বললে, সাফ হবে কেন, দুটাে-একটা চেখে দেখব শুধু। আমার বাবা ট্রেনে চাপলেই খিদে পায়। এই একঘন্টা ধরে শুধু শুধু বসে থাকতে পারব না। বের কর হাঁড়ি—চটপট—

হাঁড়ি চটপটই বেরুল—মানে, বেরুতেই হল তাকে। তারপর মার্টিনের রেলের চলার তালে তালে ঝটপট করে সাবাড় হয়ে চলল। আমি ক্যাবলা আর হাবুল সেন জুল-জুল করে শুধু তাকিয়েই রইলাম। একটা লেডিকেনি চেখে দেখতে আমরাও যে ভালোবাসি, সে-কথা আর মুখ ফুটে বলাই গেল না।

ইস্টিশান থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক হাটবার পরে ক্যাবলার মামার বাড়ি। কাঁচা রাস্তা, এঁটেল মাটি, তার ওপর কাল রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে আবার। আগে থেকেই রসগোল্লার হাড়িটা বাগিয়ে নিলে টেনিদা।।

—এটা আমি নিচ্ছি। বাকি মোটঘাটগুলো তোরা নে।

—রসগোল্লা বরং আমি নিচ্ছি, তুমি চালের পোটলাটা নাও টেনিদা। —লেডিকেনির পরিণামটা ভেবে আমি বলতে চেষ্টা করলাম।

টেনিদা চোখ পাকাল ; খবরদার প্যালা, ও-সব মতলব ছেড়ে দে। টুপটাপ করে দু-চারটে গালে ফেলবার বুদ্ধি, তাই নয়? হুঁ-হঁ, বাবা—চালাকি ন চলিষ্যতি!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাঁটরি বোঁচকা কাঁধে ফেলে আমরা তিনজনেই এগোলাম। কিন্তু তিন পাও যেতে হল না। তার আগেই ধাই—ধপাস! টেনে একখানা রাম-আছড় খেল হাবুল।

—এই খেয়েছে কচুপোড়া! —টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল।

সারা গায়ে কাদা মেখে হাবুল উঠে দাঁড়াল। হাতের ডিমের পুঁটলিটা তখন কুঁকড়ে এতটুকু— হলদে রস গড়াচ্ছে তা থেকে।

ক্যাবলা বললে, ডিমের ডালনার বারোটা বেজে গেল।

তা গেল। করুণ চোখে আমরা তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। ইস-এত কষ্টের ডিম! ওরই জন্যে রাজহাঁসের কামড় পর্যন্ত খেতে হয়েছে!

টেনিদা হুঙ্কার দিয়ে উঠল; দিলে সব পণ্ড করে! এই ঢাকাই বাঙালটাকে সঙ্গে এনেই ভুল হয়েছে! পিটিয়ে ঢাকাই পরোটা করলে তবে রাগ যায়!

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, হাবুল চার টাকা চাঁদা দিয়েছে—তার আগেই কী যেন একটা হয়ে গেল! হঠাৎ মনে হল আমার পা দুটাে মাটি ছেড়ে শোঁ করে শূন্যে উড়ে গেল, আর তারপরেই—

কাদা থেকে যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন আমার মাথা-মুখ বেয়ে আচারের তেল গড়াচ্ছে। ওই অবস্থাতেই চেটে দেখলাম একটুখানি। বেশ ঝাল-ঝাল টক-টক—বেড়ে আচারটা করেছিল হাবুলের দিদিমা!

ক্যাবলা আবার ঘোষণা করলে, আমের আচারের একটা বেজে গেল!

টেনিদা খেপে বললে, চুপ কর বলছি ক্যাবলা—এক চড়ে গালের বোম্বা উড়িয়ে দেব।

কিন্তু তার আগেই টেনিদার বোম্বা উড়ল—মানে স্রেফ লম্বা হল কাদায়। সাত হাত দূরে ছিটকে গেল। রসগোল্লার হাঁড়ি—ধবধবে শাদা রসগোল্লাগুলো পাশের কাদাভরা খানার গিয়ে পড়ে একেবারে নেবুর আচার।

ক্যাবলা বললে, রসগোল্লার দুটাে বেজে গেল!

এবার আর টেনিদা একটা কথাও বললে না। বলবার ছিলই বা কী! রসগোল্লার শোকে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে চারজনে পথ চলতে লাগলাম আমরা। টেনিদা তবু লেডিকেনিগুলো সাবাড় করেছে, কিন্তু আমাদের সাত্ত্বনা কোথায়! অমন স্পঞ্জ রসগোল্লাগুলো! পাঁচ মিনিট পরে টেনিদাই কথা কইল। —তবু পোনা মাছগুলো আছে—কী বলিস! খিচুড়ির সঙ্গে মাছের কালিয়া আর আলুভাজা—নেহাত মন্দ হবে না—অ্যাঁ?

হাবুল বললে, হ-হ, সেই ভালো। বেশি খাইলে প্যাট গরম হইব। গুরুপাক না খাওয়াই ভালো।

ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল: শেয়াল বলছিল, দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা!—ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে ছিল, তাই দুই-একটা হিন্দী শব্দ বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে।

টেনিদা বললে, খাট্টা! বেশি পাঁঠামি করবি তো চাঁট্ট বসিয়ে দেব!

ক্যাবলা ভয়ে স্পিকটি নট! আমি তখনও নাকের পাশ দিয়ে বাল-বাল টক-টক তেল চাটছি। হঠাৎ বুক-পকেটটা কেমন ভিজে-ভিজে মনে হল। হাত দিয়ে দেখি, বেশ বড়ো-সড়ো এক-টুকরো আমের আচার তার ভেতরে কায়েমি হয়ে আছে।

—জয়গুরু! এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে সেটা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। সত্যি—হাবুলের দিদিমা বেড়ে আচার করেছিল! আরও গোটাকয়েক যদি ঢুকত!

বাগান-বাড়িতে পৌঁছুলাম আরও পনেরো মিনিট পরে।

চারিদিকে সুপুরি আর নারকেলের বাগান—একটা পানা-ভর্তি পুকুর, মাঝখানে, একতলা বাড়িটা। কিন্তু ঘরে চাবিবন্ধ। মালীটা কোথায় কেটে পড়েছে, কে জানে।

টেনিদা বললে, কুছ্‌ পরোয়া নেই। চুলোয় যাক মালী। বলং বলং বাহুবলং—নিজেরা উনুন খুঁড়ব—খড়ি কুড়ুব, রান্না করব—মালী ব্যাটা থাকলেই তো ভাগ দিতে হত! যা হাবুল-ইট কুড়িয়ে আন—উনুন করতে হবে। প্যালা, কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আয়,—ক্যাবলাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যা।

—আর তুমি?—আমি ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।

—আমি?—একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে টেনিদা হাই তুলল: আমি এগুলো সব পাহারা দিচ্ছি। সবচাইতে কঠিন কাজটাই নিলাম আমি। শেয়াল কুকুর এলে তাড়াতে হবে তো। —যা তোরা—হাতে-হাতে বাকি কাজগুলো চটপট সেরে আয়।

কঠিন কাজই বটে! ইস্কুলের পরীক্ষার গার্ডদেরও অমনি কঠিন কাজ করতে হয়। ত্রৈরাশিকের অঙ্ক কষতে গিয়ে যখন ‘ঘোড়া-ঘোড়া ঘাস-ঘাস’ নিয়ে আমাদের দম আটকাবার জো, তখন গার্ড মোহিনীবাবুকে টেবিলে পা তুলে দিয়ে ‘ফোঁরর-ফোঁ’ শব্দে নাক ডাকাতে দেখেছি। .

টেনিদা বললে, যা—যা সব—দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঝাঁ করে রান্নাটা করে ফ্যাল-বড্ড খিদে পেয়েছে।

তা পেয়েছে। বইকি। পুরো এক হাঁড়ি লেডিকেনি এখনও গজগজ করছে পেটের ভেতর। আমাদের বরাতেই শুধু অষ্টরম্ভা। প্যাঁচার মতো মুখ করে আমরা কাঠখড়ি সব কুড়িয়ে আনলাম।

টেনিদা লিস্টি বার করে বললে, মাছের কালিয়া-প্যালা রাঁধিবে।

আমাকে দিয়েই শুরু। আমি মাথা চুলকে বললাম, খিচুড়ি-টিচুড়ি আগে হয়ে যাক— তবে তো?

—খিচুড়ি লাস্ট আইটেম—গরম গরম খেতে হবে। কালিয়া সকলের আগে। নে প্যালা—লেগে যা—

ক্যাবলার মা মাছ কেটে নুন-টুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন, তাই রক্ষা। কড়াইতে তেল চাপিয়ে আমি মাছ ঢেলে দিলাম তাতে।

আরে—এ কী কাণ্ড! মাছ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই কড়াই-ভর্তি ফেনা। তারপরেই আর কথা নেই—অতগুলো মাছ তালগোল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। মাছের কালিয়া নয়—মাছের হালুয়া।

ক্যাবলা আদালতের পেয়াদার মতো ঘোষণা করল ; মাছের কালিয়ার তিনটে বেজে গেল।

—তবে রে ইস্টুপিড—। টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল: কাঁচা তেলে মাছ দিয়ে তুই কালিয়া রাঁধছিস? এবার তোর পালাজ্বরের পিলেরই একদিন কি আমারই একদিন।

এ তো মার্টিনের রেল নয়—সোজা মাঠের রাস্তা। আমার কান পাকড়াবার জন্যে টেনিদার হাতটা এগিয়ে আসবার আগেই আমি হাওয়া। একেবারে পঞ্জাব মেলের স্পিডে।

টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, খিচুড়ির লিস্ট থেকে প্যালার নাম কাটা গেল।

তা যাক। কপালে আজ হরি-মটর আছে সে তো গোড়াতেই বুঝতে পেরেছি। গোমড়া মুখে একটা আমড়া-গাছতলায় এসে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।

বসে বসে কাঠ-পিঁপড়ে দেখছি, হঠাৎ গুটি গুটি হাবুল আর ক্যাবলা এসে হাজির।

—কী রে, তোরাও?

ক্যাবলা ব্যাজার মুখে বললে, খিচুড়ি টেনিদা নিজেই রাঁধবে। আমাদের আরও খড়ি আনতে পাঠাল।

সেই মুহুর্তেই হাবুল সেনের আবিষ্কার! একেবারে কলম্বাসের আবিষ্কার যাকে বলে!

—এই প্যালা—দ্যাখছস? ওই গাছটায় কীরকম জলপাই পাকছে!

আর বলতে হল না। আমাদের তিনজনের পেটেই তখন খিদেয় ইঁদুর লাফাচ্ছে। জলপাই—জলপাই-ই সই! সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাছে উঠে পড়লাম—আহা-টক-টক-মিঠে-মিঠে জলপাই-যেন অমৃত।

হাবুলের খেয়াল হল প্ৰায় ঘন্টাখানেক পরে।

—এই টেনিদার খিচুড়ি কী হইল?

ঠিক কথা—খিচুড়ি তো এতক্ষণে হয়ে যাওয়া উচিত। তড়াক করে গাছ থেকে নেমে পড়ল ওরা। হাতের কাছে পাতাটাতা যা পেলে, তাই নিয়ে ছুটিল উর্ধ্বশ্বাসে। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে, আশায় আশায়। মুখে যাই বলুক—এক হাতা খিচুড়িও কি আমায় দেবে না? প্ৰাণ কি এত পাষাণ হবে টেনিদার?

কিন্তু খানিক দূর এগিয়ে আমরা তিনজনেই থমকে দাঁড়ালাম। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ!

টেনিদা সেই নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বলছে, দে—দে ক্যাবলা, পিঠটা আর একটু ভাল করে চুলকে দে।

পিঠ চুলকে দিচ্ছে-সন্দেহ কী। কিন্তু সে ক্যাবলা নয়—একটা গোদা বানর।

আর চার-পাঁচটা গোল হয়ে বসেছে টেনিদার চারিদিকে। কয়েকটা তো মুঠো-মুঠো চাল-ডাল মুখে পুরছে, একটা আলুগুলো সাবাড় করছে আর আস্তে আস্তে টেনিদার পিঠ চুলকে দিচ্ছে। আরামে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে টেনিদা, থেকে থেকে বলছে, দে ক্যাবলা, আর একটু ভালো করে চুলকে দে!

এবার আমরা তিনজনে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম।: টেনিদা—বাঁদর-বাঁদর!

—কী! আমি বাঁদর!—বলেই টেনিদা হাঁ করে সোজা হয়ে বসল—সঙ্গে সঙ্গেই বাপ বাপ বলে চিৎকার!

—ইঁ-ইঁ—ক্লিচ্‌-ক্লিচ্‌! কিচ-কিচ!

চােখের পলকে বানরগুলো কাঁঠাল গাছের মাথায়। চাল-ডাল আলুর পুঁটলিও সেই সঙ্গে। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তরিবত করে খেতে লাগল—সেই সঙ্গে কী বিচ্ছিরি ভেংচি! ওই ভেংচি দেখেই না লঙ্কার রাক্ষসগুলো ভয় পেয়ে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল!

পুকুরের ঘাটলায় চারজনে আমরা পাশাপাশি চুপ করে বসে রইলাম। যেন শোকসভা! খানিক পরে ক্যাবলাই স্তব্ধতা ভাঙল।

—বন-ভোজনের চারটে বাজল।

—তা বাজল। —টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ; কিন্তু কী করা যায় বল তো প্যালা? সেই লেডিকেনিগুলাে কখন হজম হয়ে গেছে—পেট চুঁই-চুঁই করছে খিদেয়!

অগত্যা আমি বললাম, বাগানে একটা গাছে জলপাই পেকেছে, টেনিদা—

—জলপাই! ইউরেকা! বনে ফল-ভোজন—সেইটেই তো আসল বন-ভোজন! চল চল, শিগগির চল।

লাফিয়ে উঠে টেনিদা বাগানের দিকে ছুটিল।

চামচিকে আর টিকিট চেকার
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

—বুঝলি প্যালা, চামচিকে ভীষণ ডেঞ্জারাস!...

একটা ফুটাে শাল পাতায় করে পটলডাঙার টেনিদা ঘুগনি খাচ্ছিল। শালপাতার তলা দিয়ে হাতে খানিক ঘুগনির রস পড়েছিল, চট করে সেটা চেটে নিয়ে পাতাটা তালগোল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলে ক্যাবলার নাকের ওপর। তারপর আবার বললে, হুঁ হুঁ, ভীষণ ডেঞ্জারাস চামচিকে।

—কী কইর‌্যা বোঝলা—কও দেখি?—

বিশুদ্ধ ঢাকাই ভাষায় জানতে চাইল হাবুল সেন।

—আচ্ছা, বল চামচিকের ইংরেজি কি?

আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

—বল না!

শেষকালে ভেবে-চিন্তে ক্যাবলা বললে, স্মল ব্যাট। মানে ছােট বাদুড়!

—তোর মুণ্ডু।

—আমি বললাম, তবে ব্যাটলেট। তা-ও নয়? তা হলে? ব্যাটস সান—মানে, বাদুড়ের ছেলে? হল না? আচ্ছা, ব্রিক ব্যাট কাকে বলে?

টেনিদা বললে থাম উল্লুক! ব্রিক ব্যাট হল থান ইট! এবার তাই একটা তোর মাথায় ভাঙব।

হাবুল সেন গভীর মুখে বললে, হইছে।

—কী হল?

—স্কিন মোল।

—স্কিন মোল?...টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে মনুমেন্টের মতো উঁচু করে ধরল, সে আবার কী?

—স্কিন মনে হইল চাম— অর্থাৎ কিনা চামড়া। আর আমাগো দ্যাশে ছুঁচারে কয় চিকা— মোল। দুইটা মিলাইয়া স্কিন মোল।

টেনিদা খেপে গেল : দ্যাখা হাবুল, ইয়ার্কির একটা মাত্রা আছে, বুঝলি? স্কিন মোল। ইঃ—গবেষণার দৌড়টা দেখ একবার।

আমি বললাম, চামচিকের ইংরেজী কী তা নিয়ে আমাদের জ্বালাচ্ছ কেন? ডিক্সনারি দ্যাখো গে!

—ডিক্সনারিতেও নেই। —টেনিদা জয়ের হাসি হাসল।

—তা হলে?

—তা হলে এইটাই প্রমাণ হল চামচিকে কী ভীষণ জিনিস। অর্থাৎ এমন ভয়ানক যে চামচিকাকে সাহেবরাও ভয় পায়! মনে কর না— যারা আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে সিংহ আর গরিলা মারে, যারা যুদ্ধে গিয়ে দমদম বোমা আর কামান ছোড়ে, তারা সুদ্ধ চামচিকের নাম করতে ভয় পায়। আমি নিজের চোখেই সেই ভীষণ ব্যাপারটা দেখেছি।

কী ভীষণ ব্যাপার?—গল্পের গন্ধে আমরা তিনজনে টেনিদাকে চেপে ধরলাম: বলো এক্ষুনি।

—ক্যাবলা, তাহলে চটপট যা। গলির মোড় থেকে আরও দুআনার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়। রসদ না হলে গল্প জমবে না।

ব্যাজার মুখে ক্যাবলা ঘুগনি আনতে গেল। দু’আনার ঘুগনি একাই সবটা চেটেপুটে খেয়ে, মানে আমাদের এক ফোঁটাও ভাগ না দিয়ে, টেনিদা শুরু করলে : তবে শোন—

সেবার পাটনায় গেছি ছোটমামার ওখানে বেড়াতে। ছোটমামা রেলে চাকরি করে— আসার সময় আমাকে বিনা টিকিটেই তুলে দিলে দিল্লি এক্সপ্রেসে। বললে, গাড়িতে চ্যাটার্জি যাচ্ছে ইনচার্জ— আমার বন্ধু। কোনও ভাবনা নেই-সেই-ই তোকে হাওড়া স্টেশনের গেট পর্যন্ত পার করে দেবে!

নিশ্চিন্ত মনে আমি একটা ফাঁকা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় চড়ে লম্বা হয়ে পড়লাম।

শীতের রাত। তার ওপর পশ্চিমের ঠাণ্ডা— হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি ধরায়।

কিন্তু কে জানত— সেদিন হঠাৎ মাঝপথেই চ্যাটার্জির ডিউটি বদলে যাবে। আর তার জায়গায় আসবে—কী নাম ওর— মিস্টার রাইনোসেরাস।

ক্যাবলা বললে, রাইনোসেরাস মানে গণ্ডার।

—থাম, বেশি বিদ্যে ফলাসনি। ...টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, যেন ডিক্সনারি একেবারে। সায়েবের বাপ-মা যদি ছেলের নাম গণ্ডার রাখে— তাতে তোর কী র‌্যা? তোর নাম যে কিশলয় কুমার না হয়ে ক্যাবলা হয়েছে, তাতে করে কী ক্ষেতি হয়েছে শুনি?

হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও— ছাড়ান দাও। পোলাপান!

—হুঁ, পোলাপান! আবার যদি বকবক করে তো জলপান করে ছাড়ব! যাক— শোন। আমি তো বেশ করে গাড়ির দরজা-জানালা এঁটে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। একে দুখানা - কম্বলে শীত কাটছে না, তার ওপরে আবার খাওয়াটাও হয়ে গেছে বড্ড বেশি। মামাবাড়ির কালিয়ার পাঠাটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে গাড়ির তালে তালে পেটের ভেতর শিং দিয়ে ঢুঁ মারছে। লোভে পড়ে অতটা না খেয়ে ফেলেই চলত।

পেট গরম হয়ে গেলেই লোকে নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখে— জানিস তো? আমিও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আমার পেটের ভেতরে সেই যে বাতাপি না ইল্বল কে একটা ছিল— সেইটে পাঁঠা হয়ে ঢুকেছে। একটা রাক্ষস হিন্দি করে বলছে : এ ইল্বল— আভি ইসকো পেট ফাটাকে নিকাল আও—

—বাপরে— বলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। চোখ চেয়ে দেখি, গাড়ির ভেতরে বাতাপি বা ইম্বল কেউ নেই-— শুধু ফর-ফর করে একটা চামচিকে উড়ছে। একেবারে বোঁ করে আমার মুখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল-নাকটাই খিমচে ধরে আর কি!

এ তো আচ্ছা উৎপাত।

কোন দিক দিয়ে এল কে জানে? চারিদিকে তো দরজা-জানালা সবই বন্ধ। তবে চামচিকের পক্ষে সবই সম্ভব। মানে অসাধ্য কিছু নেই।

একবার ভাবলাম, উঠে। ওটাকে তাড়াই। কিন্তু যা শীত—কম্বল ছেড়ে নড়ে কার সাধ্যি। তা ছাড়া উঠতে গেলে পেট ফুঁড়ে শিং-টিং সুদ্ধু পাঁঠাটাই বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। তারপর আবার যখন সাঁ করে নাকের কাছে এল, তখন বসে পড়ে আর কি। আমার খাড়া নাকটা দেখে মনুমেন্টের ডগাই ভাবল বোধ হয়।

আমি বিচ্ছিরি মুখ করে বললাম, ফর-র-ফুস! —মনে চামচিকেটিকে ভয় দেখলাম। তাইতেই আঁতকে গেল কি না কে জানে— সাঁ করে গিয়ে ঝুলে রইল একটা কোট-হ্যাঙ্গারের সঙ্গে। ঠিক মনে হল, ছােট একটা কালো পুটলি ছুলছে!

এত রাত্তিরে কে আবার জ্বালাতে এল? নিশ্চয় কোনও প্যাসেঞ্জার। প্রথমটায় ভাবলাম, পড়ে থাকি ঘাপটি মেরে। যতক্ষণ খুশি খটখটিয়ে কেটে পড়ুক লোকটা। আমি কম্বলের ভেতরে মুখ ঢোকালাম।

কিন্তু কী একটা যাচ্ছেতাই স্টেশনে যে গাড়িটা থেমেছে কে জানে! সেই যে দাঁড়িয়ে আছে—একদম নট নড়ন-চড়ন! যেন নেমন্তন্ন খেতে বসেছে! ওদিকে দরজায় খটখটানি সমানে চলতে লাগল। ভেঙে ফেলে আর কি!

এমন বেয়াক্কেলে লোক তো কখনও দেখিনি! ট্রেনে কি আর কামরা নেই যে এখানে এসে মাথা খুঁড়ে-মরছে! ভারি রাগ হল। দরজা না খুলেও উপায় নেই— রিজার্ভ গাড়ি তো নয় আর। খুব কড়া গলায় হিন্দীতে একটা গালাগাল দেব মনে করে উঠে পড়লাম।

ক্যাবলা হঠাৎ বাঁধা দিয়ে বললে, তুমি মোটেই হিন্দী জানো না টেনিদা!

—মানে।

—তুমি যা বলে তা একেবারেই হিন্দী হয় না। আমি ছেলেবেলা থেকে পশ্চিমে ছিলাম—

—চুপ কর বলছি ক্যাবলা!—টেনিদা। হুঙ্কার ছাড়ল ; ফের যদি ভুল ধরতে এসেছিস তো এক চাঁটিতে তোকে চাপাটি বানিয়ে ফেলব! আমার হিন্দী শুনে বাড়ির ঠাকুর পর্যন্ত ছাপরায় পালিয়ে গেল, তা জানিস?

হাবুল বললে, ছাইড়্যা দাও— চ্যাংড়ার কথা কি ধরতে আছে?

—চ্যাংড়া! চিংড়িমাছের মতো ভেজে খেয়ে ফেলব! আমি বললাম, ওটা অখাদ্য জীব— খেলে পেট কামড়াবে, হজম করতে পারবে না। তার চেয়ে গল্পটা বলে যাও।

—হুঁ, শোন! —টেনিদা ক্যাবলার ছ্যাবলামি দমন করে আবার বলে চলল : উঠে দরজা খুলে যেই বলতে গেছি— এই আপ কেইসা আদমি। হ্যায়— সঙ্গে সঙ্গে গাঁক গাঁক করে আওয়াজ!

—গাঁক—গাঁক?

—মানে সায়েব। মানে টিকিট চেকার।

—সেই রাইনোসেরাস? বকুনি খেয়েও ক্যাবলা সামলাতে পারল না।

—আবার কে? একদম খাঁটি সায়েব-পা থেকে মাথা ইস্তক।

সেই যে একরকম সায়েব আছে না? গায়ের রং মোষের মতো কালো, ঘামলে গা দিয়ে কালি বেরোয়— তাদের দেখলে সায়েবের ওপরে ঘেন্না ধরে যায়— মোটেই সে-রকমটি নয়। চুনকাম করা ফর্সা রঙ— হাঁড়ির মতো মুখ, মোটা নাকের ছাঁদায় বড় বড় লালচে লোম— হাসলে মুখ ভর্তি মুলো দেখা যায়, আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে— একেবারে সেই জিনিসটি! ঢুকেই চোস্ত ইংরেজীতে আমাকে বললে, এই সন্ধেবেলাতেই এমন করে ঘুমোচ্ছ কেন? এইটেই সবচেয়ে বিচ্ছিরি হ্যাবিট।

—কী রকম চোস্ত ইংরেজী টেনিদা? আমি জানতে চাইলাম।

—সে-সব শুনে কী করবি?...টেনিদা উঁচু দরের হাসি হাসল! শুনেও কিছু বুঝতে পারবি না-সায়েবের ইংরেজী কিনা! সে যাক। সায়েবের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠল রাত বারোটাকে বলছে সন্ধেবেলা। তা হলে ওদের রাত্তির হয়। কখন? সকালে নাকি?

তারপরেই সায়েব বললে, তোমার টিকিট কই?

আমার তো তৈরী জবাব ছিলই। বললাম, আমি পাটনার বাঁড়ুজ্যে মশাইয়ের ভাগনে। আমার কথা ক্রু-ইন-চার্জ চাটুজ্যেকে বলা আছে।

তাই শুনে সায়েবটা এমনি দাঁত খিঁচোল যে, মনে হল মুলোর দোকান খুলে বসেছে। নাকের

লোমের ভেতরে যেন ঝড় উঠল, আর বেরিয়ে এল খানিকটা গর-গরে আওয়াজ!

যা বললে, শুনে তো আমার চোখ চড়ক গাছ।

—তােমার বাড়ুজ্যে মামাকে আমি থোরাই পরোয়া করি! এসব ডাবলুটিরা ও-রকম ঢের মামা পাতায়। তা ছাড়া চাটুজ্যের ডিউটি বদল হয়ে গেছে— আমিই এই ট্রেনের ক্রু-ইন-চার্জ। অতএব চালাকি রেখে পাটনা-টু-হাওড়া সেকেন্ড ক্লাস ফেয়ার আর বাড়তি জরিমানা বের করো।

পকেটে সব সুদ্ধ পাঁচটা টাকা আছে— সেকেন্ড ক্লাস দূরে থাক, থার্ড ক্লাসের ভাড়াও হয় না ; সর্ষের ফুল এর আগে দেখিনি— এবার দেখতে পেলাম! আর আমার গা দিয়ে সেই শীতেও দরদর করে সর্ষের তেল পড়তে লাগল।

আমি বলতে গেলাম, দ্যাখো সায়েব—

সায়েব সায়েব বোলো না—আমার নাম মিস্টার রাইনোসেরাস। আমার গণ্ডারের মতো গোঁ। ভাড়া যদি না দাও— হাওড়ায় নেমে তোমায় পুলিশে দেব। ততক্ষণে আমি গাড়িতে চাবি বন্ধ করে রেখে যাচ্ছি।

—কী বলব জানিস প্যালা— আমি পটলডাঙার টেনিরাম— অমন ঢের সায়েব দেখেছি। ইচ্ছে করলেই সায়েবকে ধরে চলতি গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা বোষ্টুম— জীবহিংসা করতে নেই, তাই অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিলাম।

হাবুল সেন বলে বসল ; জীবহিংসা কর না, তবে পাঁঠা খাও ক্যান?

—আরে পাঠার কথা আলাদা। ওরা হল অবোলা জীব, বামুনের পেটে গেলে স্বর্গে যায়। পাঁঠা খাওয়া মানেই জীবে দয়া করা! সে যাক। কিন্তু সায়েবকে নিয়ে এখন আমি করি কী? এ তো আচ্ছা প্যাঁচ কষে বসেছে! শেষকালে সত্যিই জেলে যেতে না হয়!

কিন্তু ভগবান ভরসা!

পকেট থেকে একটা ছোট খাতা বের করে সায়েব কী লিখতে যাচ্ছিল পেনসিল দিয়ে হঠাৎ সেই শব্দ—ফর-ফর—ফরাৎ!

চামচিকেটা আবার উড়তে শুরু করেছে। আমার মতোই তো বিনাটিকিটের যাত্রী— চেকার দেখে ভয় পেয়েছে নিশ্চয়।

আর সঙ্গে সঙ্গেই সায়েব ভয়ানক চমকে উঠল। বললে, ওটা কী পাখি? জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, চামচিকে— কিন্তু তার আগেই সায়েব হাইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল। নাকের দিকে চামচিকের এত নজর কেন কে জানে— ঠিক সায়েবের নাকেই একটা ঝাপটা মেরে চলে গেল।

ওটা কী পাখি? কী বদখত দেখতে - সায়েব কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল! চুনকাম-করা মুখটা তার ভয়ে পানসে হয়ে গেছে।

আমি বুঝলাম এই মওক! বললাম, তুমি কি ও-পাখি। কখনও দ্যাখোনি?

—নো—নেভার! আমি মাত্ৰ ছমাস আগে আফ্রিকা থেকে ইণ্ডিয়ায় এসেছি। সিংহ দেখেছি— গণ্ডার দেখেছি— কিন্তু—

সায়েব শেষ করতে পারল না। চামচিকেটা আর একবার পাক খেয়ে গেল। একটু হলেই প্রায় খিমচে ধরেছিল সায়েবের মুখ। বোধহয় ভেবেছিল, ওটা চালকুমড়ো।

সায়েব বললে, মিস্টার— ও কি কামড়ায়?

আমি বললাম, মোক্ষম। ভীষণ বিষাক্ত! এক কামড়েই লোক মারা যায়। এক মিনিটের মধ্যেই।

—হােয়াট! —বলে সায়েব লাফিয়ে উঠল। তারপরে আমার কম্বল ধরে টানাটানি করতে লাগল।

—মিস্টার—প্লিজ—ফর গডস সেক— আমাকে একটা কম্বল দাও।

—তারপর আমি ওর কামড়ে মারা যাই আর কি ৷ ও সব চলবে না! —আমি শক্ত করে কম্বল চেপে রইলাম!

—অ্যাঁ? তা হলে!— বলেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল সায়েব। বোঁ করে একেবারে চেন ধরে ঝুলে পড়ল প্ৰাণপণে। তারপর জানলা খুলে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল। : হেলপ—হেলপ—আর খোলা জানলা পেয়েই সাহেবের কাঁধের ওপর দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চামচিকে ভ্যানিস!

সায়েব খানিকক্ষণ। হতভম্ব হয়ে রইল। একটু দম নিয়ে মস্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, যাক— স্যামসিকেটা বাইরে চলে গেছে। এখন আর ভয় নেইকী বলে?

আমি বললাম, না, তা নেই। তবে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দেবার জন্য তৈরি থাকো।

সাহেবের মুখ হাঁ হয়ে গেল : কেন?

—বিনা কারণে চেন টেনেছ— গাড়ি থামল বলে! আর শোনো সায়েব— চামচিকে খুব লক্ষ্মী পাখি। কাউকে কামড়ায় না—কাউকে কিছু বলে না। তুমি রেলের কর্মচারী হয়ে চামচিকে দেখে চেন টেনেছ— এ জন্যে তোমার শুধু ফাইন নয়— চাকুরিও যেতে পারে।

ওদিকে গাড়ি আস্তে আস্তে থেমে আসছে তখন। মিস্টার রাইনােসেরাস কেমন মিটমিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ভয়ে এখন প্রায় মিস্টার হেয়ার—মানে খরগোশ হয়ে গেছে।

তারপরই আমার ডান হাত চেপে ধরল দুহাতে। —শোনো মিস্টার, আজ থেকে তুমি আমার বুজুম ফ্রেণ্ড! মানে প্ৰাণের বন্ধু। তোমাকে আমি ফাস্ট ক্লাস সেলুনে নিয়ে যাচ্ছি— দেখবে তোফা ঘুম দেবে। হাওড়ায় নিয়ে গিয়ে কোলনারের ওখানে তোমাকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। শুধু গার্ড এলে বলতে হবে, গাড়িতে একটা গুণ্ডা পিস্তল নিয়ে ঢুকেছিল, তাই আমরা চেন টেনেছি। বলো — রাজি?

রাজি না হয়ে আর কী করি! এত করে অনুরোধ করছে যখন।

বিজয়গর্বে হাসলে টেনিদা : যা ক্যাবলা— আর চার পয়সার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়।

বিশ্বমামার ভূত ধরা
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমার বন্ধু বাপ্পা কী দারুণ ভাগ্যবান। তার কাকা লটারিতে এক কোটি টাকা পেয়ে গেলেন।

বাপ্পা নিজে পায়নি, তাতে কী হয়েছে। ওর কাকা তো পেয়েছেন। এক মাত্র কাকা।

এক কোটি টাকা মানে কত? একের পিঠে সাতটা শূন্য! ওরে বাবা, এত টাকা দিয়ে মানুষ কী করে! অত টাকার কথা ভাবতে আমারই মাথা ঘুরে যাচ্ছে।

কেউ হঠাৎ বড়লোক হলে অমনি তার আশেপাশে ভিড় জমে যায়। বাপ্পাদের বাড়িতে এখন সব সময় অনেক লোক। তারা নানারকম পরামর্শ দেয়। কেউ বলে বোতলের জলের ব্যবসা করতে, কেউ বলে, আপনার মায়ের নামে একটা মন্দির বানিয়ে ফেলুন না। আর সবাই বললেন, আমাদের গ্রামে একটা রাস্তা বানিয়ে দিন।

বাপ্পার বীরুকাকা এইসব শুনে মুচকি মুচকি হাসেন। কারও-কে হা-ও বলেন না, -ও বলেন না। কত লোক চাঁদা চাইতে আসে। তাদের তিনি বলেন হবে, পরে হবে।

হঠাৎ একদিন বীরুকাকা উধাও হয়ে গেলেন।

একমাস বাদে তার খোঁজ পাওয়া গেল। বাপ্পার বাবাকে তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি টাকি নামে একটা জায়গায় একটা বাড়ি কিনেছেন, সেখানেই থাকবেন, কলকাতায় আর ফিরবেন না কখনো। ওখানে আর কেউ তাকে জ্বালাতন করতে পারবে না।।

প্রথমবার বাপ্পা টাকিতে গিয়ে সেই বাড়ি দেখে এসে আমাদের যা বলল, তা শুনে আমরা একেবারে হাঁ। সে যে কী দারুণ সুন্দর বাড়ি আর কী বিশাল বাগান, তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না? সেটা আগে এক জমিদারের বাড়ি ছিল, তারা এখন খুব গরিব হয়ে গেছে, তাই বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে।

বীরুকাকা সেই বাড়িটা কিনেছেন বিরাশি লক্ষ টাকা দিয়ে। জমিদারদের বংশে এখন তেইশ জন শরিক, তাদের মধ্যে টাকাটা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। আমি মনে-মনে বিরাশিকে তেইশ দিয়ে ভাগ করার একবার চেষ্টা করলাম। তারপরই মনে হল, আমি তো টাকা পাচ্ছি না। আমার হিসেব করার দরকার কী?

অত টাকা দিয়ে শুধু-শুধু একটা বাড়ি কেনার কোনও মানে হয়?

বীরুকাকা বলেছেন, সারাজীবন তিনি ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন, তাই তার নিজস্ব একটা বাড়ির খুব শখ ছিল। লটারিতে জেতার খবরটা যেদিন পান, তার আগের রাত্তিরেই তিনি একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলেন। পুরোনো আমলের সুন্দর দোতলা বাড়ি, সামনে মস্ত বড় পুকুর, দুপাশে বাগান। ওইরকম স্বপ্ন তিনি দেখলেন কেন? নিশ্চয়ই লটারির টাকা পাওয়ার সঙ্গে ওই রকম একটা বাড়ির সম্পর্ক আছে। অনেক খুঁজে-খুঁজে টাকিতে তিনি প্রায় স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যাওয়া বাড়িটা দেখতে পেলেন আর অমনি কিনে নিলেন।

বাপ্পা আর ওর বোনেরা সেখানে প্রত্যেক শনিবারে যায়। সে বাড়ির পুকুর ভর্তি কত বড়-বড় মাছ, আর বাগানে কত ফুল, সেই গল্প করে।

আর একমাস পরেই জানা গেল, সেটা ভূতের বাড়ি। এক রবিবার বাপ্পা টাকি থেকে ফিরে এল, তার বাঁ-পায়ে মস্ত বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভূতে তার পা ভেঙে দিয়েছে।

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বাপ্পাই সবচেয়ে বেশি গুলবাজ! এমন সুন্দর ভাবে গল্প বলে যে বিশ্বাস করে ফেলতে হয়। টাকির ওই অতবড় বাড়ির গল্প কি তবে গুল। বলতে-বলতে একেবারে ভূত এনে ফেলেছে।

আমি জিগ্যেস করলুম, ভূতে তোর পা ভাঙল কী করে রে? ঠেলা মারল? ঠিক দুকুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা।।

বাপ্পা বলল, নীলু তুই বিশ্বাস করিস না তো? তুই এই শনিবার চল আমার সঙ্গে। নিজের কানে শুনবি।

শুনেই আমি এক পায়ে খাড়া। আর কিছু না হোক, বেড়ানো তো হবে।

টাকি খুব দূর নয়। কলকাতা থেকে একটা বাসে যাওয়া যায় হাসনাবাদ। সেখান থেকে আর এক বাসে টাকি।।

পোঁছে দেখি, বাপ্পা তো একটুও মিথ্যে বলেনি। বিরাট লোহার গেট, তারপর লাল সুরকি বেছান রাস্তা, বাড়িটা প্রায় দুর্গের মতন। তার সামনে একটা চারকোণা মস্ত বড় পুকুর, সেটাকে দিঘিই বলা উচিত। টলটলে জল। অনেক মাছ থাকতেই পারে। দুপাশে বাগান, একদিকে সব ফুল গাছ। আর একদিকে ফলের গাছ। মস্ত-মস্ত সব গাছ, সে বাগানটা অনেকখানি ছড়ানো।

বাড়িটা বেশ পুরোনো, দেওয়ালে শ্যাওলা জমে গেছে। এরকম বাড়িতে ভূত থাকা স্বাভাবিক। সিমলায় এ রকম ভূতের বাড়ি দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, ছোটবেলা থেকেই আমি বিশ্বমামার চ্যালা। বিশ্বমামা যে বলে দিয়েছেন, ভূত বলে কিছু নেই। আজ পর্যন্ত কেউ সত্যি-সত্যি ভুত দেখেনি। অনেক মানুষ এমনি-এমনি ভয় পায়।

আমি জিগ্যেস করলুম, ভূতটা কোথায় থাকে রে? এই বাড়ির ছাদে, চিলেকোঠায়? বাপ্পা বললে, না।

তারপর আঙুল দেখিয়ে বললে, থাকে ওই ফলের বাগানে। বোধহয় ব্রহ্মদৈত্য। ব্রহ্মদৈত্যরা বাড়িতে থাকে না। গাছে থাকে।

আবার জিগ্যেস করলুম, তুই নিজের চোখে দেখেছিস? বাপ্পা বলল, দেখা দেয় না। কথা শোনা যায়, ভয় দেখায়।

বীরুকাকা বসে আছেন বৈঠকখানায়। হাতে একখানা বই। সেই ঘর ভর্তি অনেক বই, পাশের ঘরে তিন চারখানা বই ভর্তি আলমারি। বীরুকাকা এখানে সর্বক্ষণ বই পড়েন।

এত বড় বাড়িতে এখন দুজন মাত্র কর্মচারী। এক জন দরোয়ান, আর একজন রান্নার ঠাকুর। দারোয়ানের আবার কাল থেকে জুর হয়েছে। আমি বীরুকাকাকে প্রণাম করতেই তিনি বাপ্পার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, এ কে?

বাপ্পা বললে, আমার বন্ধু নীলু, ও খুব আসতে চাইছিল—

বীরুকাকা বললেন, ওকে বুঝি ভূত দেখাতে এনেছিস? এবার সারা কলকাতায় রটে যাবে দলে-দলে লোক ছুটে আসবে।

বাপ্পা বলল, না, না, নীলু আর কারুকে বলবে না।

আমি ফস করে জিগ্যেস করলুম, বীরুকাকা, সত্যি এখানে ভূত আছে? বীরুকাকা বললেন, আছে তো বটে, কিন্তু সে তো কারুর ক্ষতি করে না। বাপ্পা বলেছিল, ওর কথা শুনে আমার যে পা ভাঙল। বীরুকাকা বললেন, তুই ভয় পেয়ে দৌড়েছিলি, তাই আছাড় খেয়ে পা ভেঙেছিস। বাপ্পা বলল, রান্নার ঠাকুর যে বমি করল?

বীরুকাকা বললেন, আমি কারুকে এখন ওই বাগানের দিকে যেতে বারণ করেছি, এখন ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। আমার এ বাড়িতে নতুন এলে তো, তাই ব্ৰহ্মদৈত্য ঠিক মেনে নিতে পারছে না। কিছুদিন কেটে যাক, আমরা যদি ওকে বিরক্ত না করি, তাহলে ও আর কিছু বলবে না।

সত্যিই তাহলে ব্রহ্মদৈত্য আছে? তবে তত একবার দেখতেই হয়। বীরুকাকা বারণ করলেও যেতে হবে। বাপ্পাও তো আমাকে সেই জন্যই নিয়ে এসেছে।

বীরুকাকা বিকেলের দিকে একবার বাজারে যান। এখানে বিকেলে বাজার বসে।

বীরুকাকা বেরিয়ে যেতেই আমরা দুজনে চলে গেলুম ফলের বাগানের দিকে। বাপ্পার এখনো সারেনি, লেংচে-লেংচে হাঁটছে।

বাপ্পা বলল, শোন নীলু, ভয় পাবি না কিন্তু। দৌড়বি না। তুই দৌড়লে আমি পিছিয়ে পড়ব। তখন যদি আমার গলা টিপে দেয়।

আমি মনে-মনে হাসলুম। বীরুকাকা যাই-ই বলুন, আমি অত সহজে ভূত কিংবা ব্রহ্মদৈত্য বিশ্বাস করতে রাজি নই। বিশ্বমামার চ্যালারা অত সহজে ভয় পায় না।

বাগানের প্রথম দিকেই অনেকগুলো আমগাছ। কচি-কচি আম হয়েছে। তারপর জাম, কাঁঠাল, লেবু, আরও কত রকম গাছ। আমি চিনি না। একটা গাছ ভর্তি বেল।

হাঁটতে-হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এলুম। বাগান তো নয়, যেন জঙ্গল। এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না। এপাশেও একটা ছোট পুকুর আছে। এমনিতেই বাগানের ভেতরটা ছায়া-ছায়া, এখন আবার সন্ধে হয়ে এসেছে। বেড়াতে ভালো লাগছে। ভয় করছে না একটুও। কোথায় ভূত কিংবা ব্রহ্মদৈত্য? তাহলে কি বাপ্পার মতন বীরুকাকাও গুল মারেন?

পুকুরটার ধার দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ গম্ভীর গলায় কে যেন ধমকে উঠল। ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। আওয়াজটা আসছে শেষ গাছের ওপর থেকে। এবার ভয়ে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। মারলুম টেনে একটা দৌড়। বাপ্পা কাতর গলায় বলতে লাগল, এই নীল, দাঁড়া, দাঁড়া, আমায় ফেলে যাস না!

আমি দৌড় থামালুম একেবারে বৈঠকখানার সিঁড়িতে পৌঁছে।

বাপ্পা এসে গেল একটু পরে। চোখ পাকিয়ে বলল, বিশ্বাসঘাতক, কাওয়ার্ড। আমাকে ফেলে পালাতে লজ্জা করল না? যদি আমার গলা টিপে দিত?

আমি একটু চুপ করে রইলুম। সত্যিই তো আমার দোষ!, তারপর ফিসফিস করে জিগ্যেস করলুম, তুই ওকে দেখতে পেলি?

বাপ্পা বললে, ওরা অশরীরী? সবসময় কি দেখা যায়? মাঝে-মাঝে স্বরূপ ধরে এবার নিজের কানে শুনলি তো?

আমি বললুম, আমার কিন্তু পা ভাঙেনি, কোনও ক্ষতিও হয়নি। বাপ্পা বলল, দ্যাখ না কী হয়। ও ধমকালে একটা না একটা কিছু হবেই।

সত্যিই, সে রাতে আমার জ্বর এসে গেল। রাত্তিরবেলা খালি মনে হতে লাগল, মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ, মাথায় জটা, চোখ দুটো আগুনের ভাটার মতন, একটা ব্রহ্মদৈত্য জানলা দিয়ে আমাকে দেখছে।

পরদিন সকালে আমি জুর গায়েই পালিয়ে এলুম কলকাতা।

বিশ্বমামা কিছুদিন ধরে খুব ব্যস্ত। বিনা বিদ্যুতে ঘরের পাখা চালানো যায় কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা করছেন। মন দিয়ে শুনলেন আমার কথা।

তারপর বললেন, আমার চ্যালা হয়ে তুই যখন ভয় পেয়েছিস, তখন তো ব্যাপারটা সিরিয়াস মনে হচ্ছে। তুই নিজের কানে শুনেছিস?

--হ্যাঁ।

--স্পষ্ট?

--স্পষ্ট মানুষের গলা। --কোনও লোককে দেখতে পাসনি।

--না। গাছের ওপর-ওপর লুকিয়ে থাকতে পারে।

--তাহলে তো এগিয়ে দেখতে হয়। চল কালকেই যাই।

--কিন্তু বীরুকাকা যদি রেগে যান? উনি এ নিয়ে বেশি হই-চই পছন্দ করেন। কলকাতা থেকে কেউ যাক, উনি চান না।

--আরে বীরুকাকা মানে বীরেশ্বর দত্ত তো? আমাকে উনি ভালোই চেনেন। লটারির টাকা পেয়ে বড়লোক হয়েছেন বলে তো আর আমাকে ভুলে যাবেন না!

পরদিন বিশ্বমামার গাড়িতে চেপে বসলুম আমি আর বাপ্পা। খানিকবাদে বিশ্বমামা বললেন, তোরা গাড়ি-ভূত দেখেছিস কখনো? আমি আর বাপ্পা চোখ বড়-বড় করে তাকালুম।

বিশ্বমামা বললেন, একটু চুপ করে থাক।

হঠাৎ মিষ্টি মেয়েলি গলায় কে যেন বলে উঠল আজ মঙ্গলবার, ৭ সেপ্টেম্বর, এখন বেশ ভালো রোদ উঠেছে। কিন্তু বিকেলের দিকে বৃষ্টি হবে। রাস্তাটা ভালো নয়, একটু সাবধানে চালাও!’

কথাটা থেমে যাওয়ার পর বিশ্বমামা বললেন, দেখলি আমার গাড়ি কীরকম কথা বলে।

আমি বললুম, এটা গাড়ি-ভূত তো নয়, গাড়ি-পেত্নী হতে পারে। মেয়ের গলা।

বিশামা বললেন, তা ঠিক গাড়ি-পেত্নী শুনতে ভালো না। গাড়ি-পরী বললে কেমন হয়?

বাপ্পা বললে, আপনি গাড়িতে কোনও যন্ত্র লাগিয়েছেন।

বিশ্বমামা বললেন, এটা আমার আবিষ্কার করা যন্ত্র। আবহাওয়া বলে দেবে, রাস্তার অবস্থা বলে দেবে।

বাপ্পা বললে, আমার কাকার বাগানবাড়িতে আমরা শুনেছি, তা কিন্তু কোনও যন্ত্র হতে পারে না। বাগানে কে যন্ত্র বসাবে? তাছাড়া যখনই ও ধমকে বলে, দেখাচ্ছি মজা, তারপরই কারুর জ্বর হয়, কারও পা মচকায়, কারুর বমি হয়।

বিশ্বমামা বললেন, হাঁ!

টাকির সেই বাগানবাড়িতে পৌঁছে বিশ্বমামা খুব খুশি। বারবার বলতে লাগলেন, দারুণ বাড়ি। চমৎকার বাড়ি। এত খোলামেলা। এখানে এসে মাঝে-মাঝে থাকতে হবে।

বীরুকাকার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি সেই কথা শুনে বললেন, বিশ্ব, তুমি এসেছ, বেশ করেছ। যতদিন ইচ্ছে থাকে। কিন্তু বাগানের দিকে গিয়ে গোলমাল করো না।

বিশ্বমামা বললেন, বীরুকাকা আপনি ভূত পুষেছেন এখানে।

বীরুকাকা বললেন, আমি কুকুর পুষি না। বেড়াল পুষি না। ভূত পুষতে যাব কেন? ভূত কাকে বলে আমি জানিই না। তবে বাগানে কে একজন কথা বলে। আমরা কেউ ওদিকে যাই, সে পছন্দ করে না। তাই ধমকায়।

বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, আপনিও শুনেছেন?

বীরুকাকা বললেন, হ্যাঁ, একবার শুনেছি। আর ওদিকে যাই না। বিশ্বমামা বললেন, আপনার কোনও ক্ষতি হয়েছে? জ্বর কিংবা পেটের অসুখ?

বীরুকাকা বললেন, নাঃ, সেরকম কিছু হয়নি।

বিশ্বমামা বললেন, আপনি বাড়ির মালিক বলে আপনার কোনও ক্ষতি করেনি। কিন্তু আপনারই বাগান অথচ সেখানে আপনি যেতে পারবেন না, এটাই বা কেমন কথা!

বীরুকাকা বললেন, আমার ধারণা, আর কিছুদিন থাকলেই ওই ভূত আমাদের চিনে যাবে। তারপর কিছু বলবে না।

বিশ্বমামা বললেন, বীরুদা আপনি লটারিতে বহু টাকা পেয়ে এমন দুর্দান্ত একটা বাড়ি কিনেছেন। ওই টাকা নিয়ে আপনি সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, বাড়িতে দশটা কাজের লোক রাখতে পারবেন, সারাজীবন রোজ রাবড়ি খেতে পারবেন। কিন্তু একটা কী জিনিস পারবেন না বলুন তো? এই যে বিশ্ব আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কান ধরে ওঠবোস করাতে পারবেন? এক কোটি টাকা পুরোটা দিয়ে দিলেও পারবেন না।

বীরুকাকা অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে আমি কান ধরে ওঠ-বোস করাতে যাব কেন?

বিশ্বমামা বললেন, ছোটবেলা থেকেই আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে। আমাকে যদি কেউ ভূত দেখাতে পারে তার সামনে আমি দশবার কান ধরে ওঠ-বোস করব। সেই জন্যই আপনার বাগানে আমি দু-একবার যেতে চাই। ভূতকে আমি বিরক্ত করব না, তাড়াবারও চেষ্টা করব না। শুধু একবার দেখব।

বীরুকাকা বললেন, শুনেছি ভূত সবসময় চোখে দেখা যায় না। অশরীরী হয়ে থাকে। আমিও তো দেখিনি শুধু তার কথা শুনেছি।

বিশ্বমামা বললেন, কথা শুনলেও চলবে। কোনও মানুষ নেই, অথচ শূন্য থেকে কথা বলছে, তাও তো ভূতের কাণ্ডই বলতে হবে।

বীরুকাকা বললেন, যেতে চাও যাও, তবে সাবধানে থেকো। বেড়াতে এসেছ, তোমার কোনও ক্ষতি হোক, তা আমি চাই না।

তারপর চা-জলখাবার খেয়ে বিকেল বেলা বাগানের কাছে এসে বিশ্বমামা বললেন, নীলু, বাপ্পা, তোরা কোন জায়গায় ভূতের কথা শুনেছিস, সেই জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে দে। তোদের সঙ্গে যেতে হবে না। আমি একা যাব।

আমার ইচ্ছে ছিল, বিশ্বমামার সঙ্গে গিয়ে ব্যাপারটা কী হয় তা দেখা। কিন্তু বিশ্বমামা দারুণ গোঁয়ার মানুষ, একবার যখন বলেছেন একা যাবেন, তখন আর ওলটানো যাবে না।

বিশ্বমামা চলে গেল বাগানে। আমরা বসে রইলুম পুকুরটার ধারে। ঘন-ঘন তাকাচ্ছি বাগানের দিকে। খালি মনে হচ্ছে, এই বুঝি বিশ্বমামা দৌড়ে বেরিয়ে আসবে।

বিশ্বমামা বাগান থেকে বেরিয়ে এল প্রায় এক ঘণ্টা পরে। দৌড়ে নয়, আস্তেআস্তে হেঁটে।

এই রে, বিশ্বমামা ভূতের কথা শুনতে পাননি নাকি? বিশ্বমামা এত বড় বিজ্ঞানী, তাকে দেখেই কি ভূত ভয় পেয়ে চুপ করে গেছে।

বিশ্বমামা তার লম্বা নাকটার ওপর হাত তুলেছেন। ওটা দেখেই বোঝা যায়, ওর মাথায় কিছু একটা নতুন আইডিয়া এসেছে।

আমাদের কাছে এসে বললেন, বেশ সুন্দর বাগানটা। পিকনিক করার পক্ষে আদর্শ।

আমি কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিগ্যেস করলুম, বিশ্বমামা, তুমি কিছু শুনতে পাওনি?

সে আর উত্তর না দিয়ে বিশ্বমামা বললেন, বল তো, কোন গাছে বাজ পড়েছে, তা কী করে বোঝা যায়?

এখন এই সব কথা শুনতে কারুর ভালো লাগে?

আমি আবার জিগ্যেস করলুম, শুনতে পেয়েছ কিনা, সেটা আগে বলল।

বিশ্বমামা বললেন, হ্যা শুনেছি। খুবই স্পষ্ট। আমার ধারণা ছিল ভূতরা নাকি সুরে কথা বলে। তা কিন্তু নয়। অবিকল মানুষের মতন গলা।

বাপ্পা জিগ্যেস করল, সেখানে কোনও মানুষ ছিল?

বিশ্বমামা মাথা নেড়ে বললেন, না কোনও মানুষ ছিল না। আমি ভাললা করে দেখেছি। গাছের ওপরেও কেউ লুকিয়ে ছিল না।

বাপ্পা বলল, তবে?

বিশ্বমামা বললেন, মানুষ নেই, অথচ কথা বলছে। এতে রহস্যময় ব্যাপার বটেই। তবে কি এবার সত্যি সত্যি কান ধরে ওঠবোস করতে হবে? আর একটা দিন সময় দরকার। তোরা কথাটা কবার শুনেছিলি?

বাপ্পা বলল, আমি দুবার।।

আমি বললুম, আমি একবার শুনেই....

বিশ্বমামা বললেন, তারপর দৌড় মেরেছিলি, তাই তো? ঠিক আছে। রাত্তিরে বীরুদা কী খাওয়াবে? এইসব জায়গায় খুব ভালো কচি পাঁঠার মাংস পাওয়া যায়-মাংসের ঝােল আর লুচি যদি হয়।

আমরা ভেবেছিলুম, বিশ্বমামার জুর কিংবা বমি হবে। সেরকম কিন্তু কিছুই হল। দিব্যি লুচি মাংস খেলেন, তারপর ঘুমােত গেলেন তাড়াতাড়ি।

পরদিন সকালে উঠে ভূত বিষয়ে কোনও কথাই বললেন না। গাড়ি নিয়ে আমরা ঘুরলাম গ্রামে-গ্রামে। এখানকার নদীতে নৌকা চেপে বেড়ানোও হল। নদীর ধারেই একটা দোকানে গরম-গরম জিলিপি পাওয়া গেল, শিঙাড়া খেলুম প্রাণভরে। এক ঠোঙা নিয়েও আসা হল বীরুকাকার জন্য।

বীরুকাকা জিলিপি খেতে-খেতে জিগ্যেস করলেন, কী বিশ্ব, কিছু বুঝলে? তোমার মতন একজন বৈজ্ঞানিক, পৃথিবীতে কত দেশে বক্তৃতা দিতে যাও, তুমি কান ধরে ওঠবোস করবে, এটা ভাবতেই আমার মজা লাগছে।

কিছু না বলে বিশ্বমামা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।

বীরুকাকা বললেন, অবশ্য, তোমাকে যে ওরকম করতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। আমি তো আর তোমার সঙ্গে বাজি ধরিনি। তুমি নিজেই ঠিক করেছ।

বিশ্বমামা বললেন, বীরুদা, আজ সন্ধেবেলা একবার আমার সঙ্গে বাগানে যাবেন?

বীরুকাকা বললেন, না, না, আমি তো বলেইছি ওসব অপদেবতাদের ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। সে তত আমাদের কোনও ক্ষতি করছে না। আমরাই বা তাকে ডিসটার্ব করতে যাব কেন? আর কথাটা বেশি রটে গেলে অনেক লোক ভিড় করে এসে ভূতের বাড়ি দেখতে চাইবে।

বিশ্বমামা বললেন, আমি ভূত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করব না। ডিসটার্বও করব না। একটা অন্য জিনিস দেখাব, নীলু আর বাপ্পাকে সঙ্গে নিতে পারি। কিন্তু ওদের ভয় পেয়ে দৌড়ানো চলবে না। না দৌড়ালে জ্বরও হবে না, পা-ও মচকাবে না।

সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর বেরিয়ে পড়লুম সদলবলে।

বাগানের মধ্যে ঢুকে বিশ্বমামা এমনভাবে এগোলেন, মনে হল উনি কোথায় যাবেন, আগে থেকেই ঠিক করা আছে।

একটা লম্বা গাছের কাছে গিয়ে তিনি থামলেন। সেটাকে গাছ বোঝাই যায় না। তালগাছ ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ওপরের ডালপালা কিছু নেই।

বিশ্বমামা বললেন, এই গাছটার ওপর বাজ পড়েছিল অনেক দিন আগে। সাধারণত এরকম লম্বা গাছের ওপরই বাজ পড়ে।

বীরুকাকা বললেন, বাজ পড়া গাছের সঙ্গে ওই ব্যাপারটার কী সম্পর্ক তা তো বুঝলাম না।

বিশ্বমামা বললেন, বুঝিয়ে দিচ্ছি। কেউ কোনও কথা বলবেন না। একদম চুপ। ভূতের রং কুচকুচে কালো।

তারপর ভূতের গলার আওয়াজ শোনার আগেই বিশ্বমামা চেঁচিয়ে বললেন, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।

সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন শোনা গেল, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।

আর কেউ নেই সেখানে, তবু শোনা গেল সেই কথা।

বিশ্বমামা একগাল হেসে বললেন, বীরুদা, নীলু, বাপ্পা, তোমরা তিনজনেই এই একই কথা শুনেছ?

তিনজনেই মাথা নেড়ে বললুম, হ্যা। বিশ্বমামা বললেন, ভূত কি শুধু এই একটাই কথা জানে? আর কিছু বলতে পারে না?

বিশ্বমামা এবার চেঁচিয়ে বললেন, রাধাকৃষ্ণ।

আর কিছু শোনা গেল না। বিশ্বমামা আবার বললেন, ময়না, বলো রাধাকৃষ্ণ।

এবার শোনা গেল, রাধাকৃষ্ণ। বীরুকাকা চোখ বড়-বড় করে বললেন, ময়না?

বিশ্বমামা বললেন, নিশ্চয়ই। টকিং বার্ড। অবিকল মানুষের গলা নকল করতে পারে। কারুর বাড়ির পোষা ময়না, আগেকার মালিক ওই কথাটা শিখিয়েছিল, চোরটোরদের ভয় দেখাবার জন্য। আপনি রাধাকৃষ্ণ বলতে শেখান, তাই শিখবে। রামসীতাও শেখাতে পারেন। ভূত তো কখনো রামনাম উচ্চারণ করে না।

আমাদের তিনজনেরই চোখে তখনই অবিশ্বাসের ছাপ দেখে বিশ্বমামা আবার বললেন, ময়না পাখি সাধারণত নির্জন জায়গায় বাসা বাঁধে। এমন গাছের ভেতরে থাকে, যে গাছে সাধারণত মানুষ ওঠে না। এই জন্য ওরা বাজ-পড়া গাছ বেশি পছন্দ করে। দেখবেন পাখিটা?

পোড়া তালগাছটা ধরে খানিকটা ঝাকাতেই তার ডগা থেকে ঝটপট করে একটা কালো রঙের পাখি বেরিয়ে উড়তে লাগল, আর বলতে লাগল, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা! রাধাকৃষ্ণ।

বিশ্বমামা বললেন, আমি ইচ্ছে করলে ওকে ধরে খাঁচায় রাখতে পার, কিন্তু আগেই কথা দিয়েছি, ওকে ডিসটার্ব করব না। ও থাক নিজের মতন!

বীরুকাকা বললেন, বিশ্ব, তোমাকে আর কান ধরে ওঠ-বোস করতে হল না। তার বদলে তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। কী চাও, বলো?

বিশ্বমামা বললেন, গলদা চিংড়ি ভাজা।

Saturday, January 6, 2018

বইপোকা
কানাই কুণ্ডু

বইপোকারা বই পড়ে না। চশমাও পরে না। এটা জেনেও সবাই সুমনকে কেন যে বইপোকা বলে! সুমন বই খায় না, পড়ে।মানুষের নানা অভ্যেস থাকে। কেউ ঘুড়ি ওড়ায়, সিনেমা দেখে, বেড়াতে যায়, খেতে ভালবাসে, রুস্তমি করে, পাড়ার দাদা হয়। আবার কেউ গান গায়, গপ্পো কবিতা লেখে, নাটক করে, সংসারও করে। সুমন এ সব কিছুই করে না, পড়ে। যত পুরনো তত আগ্রহ। এই অভ্যেসে সে কলেজ ষ্ট্রিট যায়, শ্যামবাজার, চৌরঙ্গি পাড়া, ফ্রি স্কুল ষ্ট্রিট বা গোলপার্ক। ফুটপাথে বিছানো নানা নতুন পুরনো বই। নতুনে সুমনের আগ্রহ নেই। কেবল পুরনো খোঁজে। মলাট ফর্দাফাই। হলদেটে পাতা পোকায় কুটো করা। টাইটেল পেজ নেই। নেই লেখকের নাম বা শেষের পাতা। অথবা ছেঁড়া পাতা সেলোটেপে জড়ানো।

এ ভাবেই ডিফো সুইফট ব্রন্টি থেকে শলোকভ টলস্টয়। পদাবলি থেকে মধুসূদন হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্র বিহারীলাল অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র তারকনাথ। অথবা হোমার বায়রন টেনিসন। এর আগে এগোয় না। পরের প্রজন্মের লেখকদের বই পুরনো হলেও দাম বেশি। ব্যতিক্রম কেবল উইয়ের মানচিত্র আঁকা একটি সঞ্চয়িতা। সুমনের মাসিক বরাদ্দ চল্লিশ টাকা। চার-পাঁচটার বেশি হয় না। আজকাল দাম আরও চড়ছে। সুমন পাঁচেই সন্তুষ্ট। এতেই একটা মাস কেটে যায়। শেষের দিকে ফাঁকা থাকলে আগের কেনা বই ওল্টায়।

সকালের এজমালি কাগজ হাতে আসতে সাড়ে আট। তাও পাতা ভাগ করে পড়তে নটা। কেউ কেউ আলাদা কাগজ নেয়। আমার রুমের নতুন ছোকরা জয়ন্ত নেয় টেলিগ্রাফ। বিজ্ঞাপন দেখে চাকরি বদল করে। বামার গপ্পো বাতিক আছে। সে নেয় আনন্দবাজার। নটার পরে নীচতলার চৌবাচ্চায় স্নান ইত্যাদির হুড়োহুড়ি। দু’ মুঠো গিলে বেরিয়ে পড়া।

সুমন দশটায় তৈরি হয়। আগে পরের ঝগড়া নেই, নির্বিকার। বি বি গাঙ্গুলি ধরে হেঁটে বি বা দী বাগ। একই চেয়ার টেবলে এক খাতা থেকে অন্য খাতায় টোকাটুকিতে একুশটা বছর। অথচ এরই জন্যে গ্রাজুয়েশনে প্রথম বিভাগ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা! ছুটির পর আবার হাঁটতে হাঁটতে নানা বইয়ের খোঁজ খবর। তালিকা তৈরি। মাসের মাইনে পেলে এক সপ্তাহ ধরে কেনাকাটা। দোকানদাররা তাকে চেনে। পুরনো বই তুলে রাখে। সুমনের পছন্দ না হলে অন্য খদ্দেরকে বিক্রি করে।

একবার কেনাকাটায় তার সঙ্গী ছিলাম। ভাইঝি যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য পড়ে। বাইরনের বই দরকার। সুমন বুদ্ধি দিয়েছিল, নতুন কিনবেন কেন? তিনশো টাকা দাম। আমার সঙ্গে চলুন। পুরনো কিনে দেব সস্তায়।

অফিস পাড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গি, পার্ক ষ্ট্রিটের মোড়, ভবানীপুর, রাসবিহারীতে এসে আমার ধৈর্য এবং ক্ষমতা স্তিমিত। সুমন আশ্বাস দেয়, ঠিক পাওয়া যাবে। আর একটু এগোলেই গড়িয়াহাট, গোলপার্ক। কত পুরনো বইয়ের দোকান, এদিকে আবার বেশির ভাগই ইংরেজি বই।

বললাম, কোথাও একটু বসি। চা খাই।

আগে বইটা পাওয়া যায় কি না দেখি। অকারণে খরচা করবেন?

তার অসীম ধৈর্য এবং বিনীত পথ হাঁটায় আমি বিরক্ত। ভাবি, কলেজ ষ্ট্রিটের দোকান থেকে নতুন কেনাই ঠিক ছিল। কেন যে সুমনকে বলতে গেলাম! অগত্যা পথ হাঁটি। কিছুই দেখি না। দেশপ্রিয় পার্ক পেরিয়ে লেক ভিউ’র ফুটপাথে বইটা পাওয়া গেল। পুরনো হলুদ পাতার বই। মাঝারি ডায়রির আকৃতি। সাধারণ ম্যাটমেটে বোর্ডে নতুন করে বাঁধাই। ওপরে কালো কালিতে হাতে লেখা: বায়রন’স পোয়েমস। কবিতা তখনও পোয়েট্রি হয়নি। প্রিফেসের পাতা থেকে শুরু। দ্বিতীয় মুদ্রণের প্রিফেসে প্রকাশ কাল ১৮১৩। শেষের পাতায় একটি ফুলের ছবি সহ লেখা: টেম্পল প্রেস, লেচওয়ার্থ, গ্রেট ব্রিটেন। ব্রিটেন তখন গ্রেট ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বই একবিংশ শতাব্দীর ফুটপাথে! দাম জিজ্ঞাসা করতে বলল, পঁচিশ টাকা। তবে ওনার খাতিরে কুড়ি।

সেই দিন থেকে সুমন আমার চোখে ভিন্ন এবং একা।

উত্তরে বা দক্ষিণে সুমনের পত্রচিত্র এমনই পদাতিক। মেসে ফেরে প্রায় আটটায়। হাত মুখ ধুয়ে শুকনো মুড়ি এবং চা। তেলেভাজা রোল টোস্ট ওমলেট নাকি পেটে সয় না। অন্য বোর্ডাররা বলে, পেটে নয়, পকেটে সয় না। হাড় কেপ্পন। দাড়িটা পর্যন্ত কাটে না!

তাকে রোগাই বলা যায়। লম্বা। চোখে চশমা। কাঁচা পাকা চুল। পায়ে প্লাস্টিক ফোমের চটি। খানসামার মতো খাটো পাজামা। পাঞ্জাবি কখনও গেরুয়া অথবা সাদা। শীতে বাড়তি খদ্দরের ডানা ছাঁটা কোট। মেসে লুঙ্গি গেঞ্জি।

অবনীদা মেসের মালিক। নাম বদলে গেস্ট হাউস করেছেন। আমরা বোর্ডার ছিলাম। এখন সবাই পেয়িং গেস্ট। তিনি সকালে আসেন, রাত্রে পারিবারিক ফ্ল্যাটে ফিরে যান। মহাত্মা গান্ধী রোডে তিনতলা পুরনো বাড়িতে এই গেস্ট হাউস। নীচে রাস্তার দিকের ঘরে দোকান ভাড়া দিয়েছেন। পাশের গলিতে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। নীচেই চৌবাচ্চা, বাথরুম ইত্যাদি। টানা বারান্দা। ওপরের দুই তলায় তিনটি করে বড় বড় কামরা। প্রতি কামরায় চারটি তক্তপোশ। মাঝে হাঁটা চলার জায়গা। ইদানীং পুরনো তুলোর গদি বদলে কয়্যারফোমের ম্যাট্রেশ এবং বালিশ। রাস্তার দিকে কয়েকটা বিশাল জানলা। প্রায় প্রতিটায় দু-চারটে খড়খড়ি ভাঙা। সপ্তাহে একদিন চাদর বদল হয়। ছাদের চিলেকোঠায় রান্না। নীচের বারান্দা ঘিরে ডাইনিং। তবুও এই ছয় কামরার চল্লিশ জনই পুরনো অভ্যাস এবং পরম্পরায় একে মেস বলে থাকি।

প্রতি তক্তপোশের মাথার দিকে কিছুটা জায়গা ছাড়া। সেখানে কারও আলমারি, সেলফ, র্যাক বা টেবিল নিজের পয়সায় কেনা। কোনও বোর্ডার চলে গেলে, পুরনো দামে সস্তায়। যেমন উমাপতি তক্তপোশে বসে টেবিল টেনে ছাত্রদের খাতা দেখে, নম্বর দেয়। তাপস ভাল চাকরি করে। তার টেবিল এবং আয়না লাগানো আলমারি। সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেই কাজ সারে। বামাচরণের টুল আছে। মাথার দেওয়ালে বারো মাসের লম্বা ক্যালেণ্ডার। সেখানে সে জামা প্যান্ট ঝুলিয়ে রাখে। সুবোধের খাটের নীচে কালো ঢাউস ট্রাঙ্ক। সুমনের পাশে নাইলনের দড়ি টাঙানো। সেখানে তার লুঙ্গি গেঞ্জি পাজামা। নীচে ইটের ওপর পাতা তক্তায় বইয়ের পিরামিড। পড়াশোনা তক্তপোশে। প্রতি কামরায় ঝুলে কালো হয়ে যাওয়া দুটি পাখা, তিনটি টিউব। কারও রেডিও, ট্রানজিস্টার বা টেপরেকর্ডার। তাপসের কেবল টিভি, রঙিন এবং ছোট। কেউ গান শোনে, টিভি দেখে, কেউ বা তাস খেলে। সুমন পড়ে।

আর এই পড়া নিয়েই সেদিন ক্যাচাল। বিরক্তি থেকে কলহ। আলোটা নিবিয়ে দিন না মশাই। কটা বাজে দেখেছেন?

আলো তো সবই নেবানো, শান্তভাবে বলে সুমন।

আপনার টেবিল ল্যাম্পটাও বন্ধ করুন।

আর দেড় পৃষ্ঠা।

সময় যায়। কলহ চিৎকারে পরিণত হয়। উমাপতি উঠে ল্যাম্পের সুইচ বন্ধ করে। বামাচরণ চোখের ওপরে থেকে রুমাল সরায়। সুবোধ কাগজ ভাঁজ করে রাখে।

মেসের একটা শৃঙ্খলা আছে। সেই নিয়মে সবাইকে অবনীদার অফিস ঘরে বৃহস্পতিবার উপস্থিত থাকতে হয়। আমাকেও। উমাপতি শুরু করে, আপনি পয়সা আগাম নেন, অথচ গেস্টদের অসুবিধার খবর নেন না।

অবনীদা থই পান না। আপনারা না বললে, বুঝব কী করে।

রাতের বিশ্রাম আর দু’ মুঠো খাবারের জন্যে মেসে থাকা, সুবোদের যোগান।

এটা মেস নয়।

দুটো কথার একই মানে। বেশ, গেস্ট হাউস। কিন্তু বিশ্রামে...

হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটল কেন?

রাত্রে ঘুমোতে না পারলে, বিশ্রাম হয় কেমন করে। উমাপতির রাগত অভিযোগ।

কে ঘুমোতে দেয় না? ওহ্‌, সুমন।

আরে দাদা, রাত দুটো পর্যন্ত আলো জ্বালিয়ে রাখে, বলে বামাচরণ।

তাপস বলে, কীসের এত পড়া। এই যে উমাদা, স্কুলে ছাত্র পড়ান। তাকেও তো এত পড়তে দেখি না।

উমাপতির অবজ্ঞা, বোধহয় বানান করে পড়ে। মগজে কিছু ঢোকে বলে মনে হয় না।

সুমনের নির্হিংস সাফাই, আপনারা গান শোনেন, টিভি দেখেন, তাস খেলেন। আমি তো বিরক্ত হই না। মগজ জ্ঞান এ সব প্রসঙ্গ না তোলাই ভাল।

তাপস তেড়ে আসে, উমাদার চেয়ে আপনি বেশি বোঝেন?

তেমন দাবি আমি করিনি। উনি নিশ্চয়ই বেশি বোঝেন। তবে সেদিন এক ছাত্রের খাতায় ভুল লিখতে দেখেছি।

উমাপতি চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়, ভুল লিখেছি? আমি?

তেমন কিছু নয়। হোমারের জন্মস্থান আয়োনিয়া লিখেছিলেন।

তাই তো।

না। তা নয়। গ্রিসের সাতটি শহরকে তার জন্মস্থান অনুমান করা হয়। জন্মসালও ৭০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নয়। তার জন্ম তারিখ আজও নিরূপিত হয়নি। এমনকী ওডিসি যে তাঁরই রচনা, এমন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। সবই অনুমানভিত্তিক।

উমাপতি থমকে যায়। এই তথ্য আমার জানা নেই। প্রয়োজন হয় না। আমি ইংরাজি ভার্সান পড়েছি। রিউ-র সম্পাদনা।

এই র্যু কে?

বিলেতের কোনও পণ্ডিত।

র্যু অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের দায়িত্বে বোম্বাইতে এসেছিলেন। এমনকী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারাঠা ইনফ্যান্ট্রির সৈনিক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন কিছুকাল।

উমাপতির অহমিকা গুঁড়িয়ে যায়। স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে বলে চলে যায়।

আজকাল সুমনের সঙ্গে দেখা হয় না। সে মেসে থেকেও প্রায় নেই। ওপরের চিলেকোঠার খুপরিতে আগে যেখানে রান্না হত, ওটাই তার আস্তানা। নীচের বারান্দার একাংশ ঘিরে এখন কিচেন। একদিন তাকে দেখতে গেলাম। তক্তপোশে আধশোয়া। হাতে মলাট ছেঁড়া বই। আমাকে দেখে উঠে বসল। মাথার দিকে বেশ উপরে একমাত্র ঘুলঘুলি বা জানালা। সিলিং-এ ঝোলানো তেল কালিতে বিবর্ণ দুই ব্লেডের ডি সি পাখা, দেওয়ালের হোল্ডারে বাল্‌ব এবং সুমনের মাথার পাশে বইয়ের তাকের ওপর টেবিল ল্যাম্প। তক্তার ওপরে বইয়ের পাহাড়। পাশে বসে বলি, নতুন কী পড়লে সুমন?

ঠিক বলতে পারব না।

হাতে বই। অথচ বলতে পারবে না! নামের পাতাও ছেঁড়া?

তা নয়। একটা চটি বই। নাম কলকেতার হাট হদ্দ। ১৮৬৪-তে ছাপা। লেখকের নাম নেই। ঝরঝরে চলিত ভাষা। পুরনো কলকাতাকে জীবন্ত পাওয়া যায়। অনামে কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা মনে হয়।

কিন্তু এই আলো হাওয়াহীন ঘরে তুমি যে অসুস্থ হয়ে পড়বে।

আলো তো আছে। ওপরের জানালা দিয়ে হাওয়াও আসে।

কিছুদিন না হয় বাইরে কোথাও ঘুরে এসো। দেশ গ্রামে কেউ নেই শুনেছি। দূরে কাছে আত্মীয়স্বজনও নেই? দিঘা পুরী দার্জিলিং তো পা বাড়ালেই।

ওই পয়সায় পঁচিশটা বই হবে। দেশ বিদেশের অনেক বইও আছে। ওতেই আমার দেখাশোনা জানা।

মনে পড়ে কে যেন ওকে পোকা বলেছিল এবং কিপ্টে।

সুমন এখন দিব্যি আছে। অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়ে। তাকে নিয়ে কোনও কৌতূহল বা বিরক্তি নেই। আমরাও নিয়মিত অফিস যাই, মেসে ফিরি। আমার প্রতি শুক্রবার বা ছুটির দিনে অফিস থেকে সোজা দুবরাজপুর যাওয়া আছে। সেখানে মা বউ ছেলে মেয়ে। সোমবার অফিসে হাজিরা। সন্ধ্যায় মেসে ফেরা। এই আবর্তে জীবনের অনেকগুলো বছর খরচ হয়ে যায়। বুড়ো হই।

সিঁড়ি বেয়ে সেদিনও দোতলায় ওঠার মুখে থমকে দাঁড়ালাম। অবনীদার ঘরে ভিড় কেন! দুই পুলিশকেও দেখতে পাচ্ছি। ভেতরে আসতে উমাপতিকে বলতে শুনি, কার ভেতরে কী লুকিয়ে আছে অবনীদা, আপনি কী করে বলবেন। এ রকম হতেই পারে। কারও পক্ষে এত বই কেনা সম্ভব!

সবই তো ছেঁড়া, পোকায় কাটা।

হলই বা পুরনো বই, তার দাম নেই?

প্রসঙ্গ যখন বই, নিশ্চয়ই সুমনকে নিয়ে আবার গোলমাল। আমি আগ্রহী হই, পুলিশ অফিসার বলে, পরশু রাতে এক বিখ্যাত পুরনো বইয়ের দোকানের শাটার ভেঙে চুরি হয়। ফ্রি স্কুল ষ্ট্রিটের এক হকারের কাছে কয়েকটা চোরাই বই পাওয়া যায়। সেই হকার বলেছে, দুটো বই সে নাকি এই মেসের একজনকে বিক্রি করেছে। আমরা তদন্তে এসেছি।

আমি প্রতিবাদ করি, আপনারা ভুল জায়গায় এসেছেন। বই পুরনো মানেই চোরাই নয়।

কালপ্রিট এই মেসের কথাই বলেছে। ভাল বই পেলে সে নাকি এখানে খবর দিতে আসত।

সুবোধ বলে, আমি দু-তিনজনকে আসতে দেখেছি।

উমাপতি বলে, আমিও।

অফিসার আমার দিকে তাকায়। আমরা ভুল জায়গায় আসিনি। চলুন, আপনাকে থানায় যেতে হবে।

অবনী বলেন, না না, উনি নন। বই যে কেনে, সে ফেরেনি এখনও। তার তো বিগত দশ-বারো বছর ধরে বই কেনার অভ্যাস। সবই পুরনো।

অফিসার গম্ভীর। তা হলে তো এক গভীর চক্রান্ত। এতদিন ধরে কেনাবেচার কারবার করছেন। তাও আমাদের নাকের ডগায়!

সে বই বিক্রি করে না।

নিশ্চয়ই করেন। আপনারা জানেন না।

আমরা তাকে কখনও বই বিক্রি করতে দেখিনি।

তাপস আমাকে শুধরে দেবার চেষ্টা করে, এ ভাবে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, সত্যেনদা। আমি ওকে বই নিয়ে বেরোতে দেখেছি।

ইতিমধ্যে সুমন আসে। হাতে দুটো পুরনো বই। সোজা উপরে যাচ্ছিল। উমাপতি পুলিশ অফিসারকে বলে, ওই যে আপনার আসামি।

আমি সুমনকে ডাকি। জানতে চাই, সম্প্রতি ফ্রি স্কুল ষ্ট্রিটের কোনও দোকান থেকে বই কিনেছ?

কোন দোকান থেকে কখন কী বই কিনি ঠিক মনে থাকে না, বলে সুমন।

পুলিশ অফিসার জানতে চায়, সব পুরনো?

সবই পুরনো।

রবার স্ট্যাম্প আছে?

কোনওটায় নাম লেখা, কোথায়ও বা সই তারিখ, কোথায়ও আণ্ডারলাইন, ফুট নোট। রবার স্ট্যাম্পও থাকতে পারে।

আমরা দেখতে চাই।

ওপরে চলুন।

অবনীদাকে সঙ্গে নিয়ে আমিও ওপরে যাই। সুমনের ঘরের দরজায় দড়ির ফাঁস। অফিসার বলে, এই ভাবে দরজা বন্ধ রাখেন। চুরি হয় না!

আমাদের পরস্পরে আস্থা আছে। তালার দরকার হয় না।

অফিসার কিছুটা যেন বিব্রত। মাথা নিচু। দড়ির ফাঁস খুলে অন্ধকার ঘর। ভ্যাপসা গন্ধ। সুমন আলো জ্বালায়। বিছানায় ছড়ানো বই। মাথার দিকের তক্তায় বইয়ের পাহাড়। অফিসার বলে, করেছেন কী মশাই। এই ছাইভষ্ম এখন ঘাঁটতে হবে!

সুমন উত্তর দেয় না। অফিসার কনস্টেবলকে বলে, স্ট্যাম্প মারা বই সব বের করো।

কনস্টেবল পাহাড় ভাঙে। পাতা উল্টে স্ট্যাম্প খোঁজে। জঞ্জাল সরানোর কায়দায় নীচ থেকে ওপরে তোলে। মলাট খসে। ছেঁড়া পাতা উড়ে যায়। অসহায় কাতরতায় সুমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো মনে মনে কাঁদছে। কোনও প্রতিবাদ নেই দেখে আহত হচ্ছে।

উমাপতিরা মজা দেখে। নিজেদের মধ্যে মন্তব্য চালাচালি। সব লটের দরে কেনা। এত বই তো আগে দেখিনি। বাংলা বইও চুরি হয়েছে?

অফিসার উত্তর দেয় না। এগারোখানা রবার স্ট্যাম্প দেওয়া বই পাওয়া যায়। কোথাও বোধোদয় লাইব্রেরি, শহীদ নগর পাঠাগার, হারবার্ট কলিনস, হেমন্ত পুস্তকালয়, ম্যাসাচুসেট ইউনিভার্সিটি বা বাপুজি সংঘ। ইংরাজি নামের স্ট্যাম্প দেওয়া বই অফিসার নিয়ে বলে, এগুলো আমি সিজ করলাম। কাগজে লিখে উমাপতির হাতে দিয়ে বলে, সই করুন। আপনি উইটনেস।

না না, আমি ব্যস্ত মানুষ। কোর্ট কাছারি করার সময় পাব না। এনাকে দিন, বলে আমার দিকে কাগজ বাড়িয়ে দেয়।

বই কবে ফেরত পাব, আমি জানতে চাই।

থানা থেকে ইন্ট্যাক্ট ফেরত পাবেন, যদি চোরাই না হয়।

কোন থানা?

আমহার্স্ট ষ্ট্রিট। আপনি সঙ্গে চলুন। বলে সুমনকে ডাকে।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

থানায়।

কেন?

চুরি যাওয়া বই পাওয়া গেছে। ছাড়িয়ে আনতে হলে আপনারাও আসুন। বড়বাবুকে বলে জামিন করিয়ে নেবেন।

কিন্তু ওগুলো যে চুরি যাওয়া বই তার প্রমাণ?

প্রমাণ হবে আদালতে।

থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা গেলেও কোর্টকাছারি রোধ করা যায়নি। বছর দেড়েকের টানাপোড়েন। কাউন্সিলর এম এল এ-র কাছে ধর্না, উকিল মুহুরি হাজিরার হা পিত্যেশ। তবু শেষ রক্ষা হল না। অন্তত দুটি বই যে চোরাইয়ের অন্যতম সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। চোরের অপরাধ কবুল, ফুটপাথের দোকানদারের স্বীকৃতি, নিরপরাধ অজ্ঞানতায় তার কাছ থেকে সুমনের বই কেনা এবং পার্ক লেনের বই বিক্রেতা হারবার্ট কলিনসের মালিকের শনাক্তকরণের ফলে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড।

মাঝে মাঝে দেখা করতে যাই। সুমনের কোনও বিমর্ষতা নেই। বরং বলে, আপনি কেন কষ্ট করে আসেন। এখানে আমার কোনও অসুবিধা নেই। জেলারকে বই চাইলে পড়তে দেয়। সারা রাত আলো জ্বলে। কেউ আলো নেবানোর কথা বলে না। অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়তে পারি।

বাইরে দাঁড়িয়ে আমি একা ভাবি, এই সংসারে কোনটা যে কার জেলখানা!

Monday, December 25, 2017

খালপোল ও টিনের ঘরের চিত্রকর
কানাইলাল

নতুন কংক্রিটের পোল তৈরী হওয়ার পর জায়গাটার চেহারা বদলে গেছে। এধারের খালটাকে আর চেনা যায় না। চিনতে কষ্ট হ’ত না, যদি ওপরের ডালপালা ছড়ানো প্রকাণ্ড শিরিষ গাছটা কাটা না পড়ত। কিন্তু যারা পোল তৈরী করতে এসেছিল তারা, গাছটাকে রক্ষা করতে পারেনি।

গাছ গেছে তাই আকাশ বড় হয়ে গেছে, আর তার সঙ্গে কালের পুরোনো জংলী চেহারা পাল্টে গিয়ে শহুরে শ্রী ফুটে উঠেছে। কারোর ভালো লাগে, কারোর লাগে না। শিরীষ গাছের ছায়ায় ছায়ায় কাঁটানটে আর কচুর জঙ্গল ছড়িয়ে থাকত কত! পাখির কিচিরমিচির শোনা গেছে সকাল-সন্ধ্যা। ফড়িং দেখা গেছে, প্রজাপতি দেখা গেছে। এখন সব শেষ। যেন সাদা নতুন চুনকাম করা বিশালকায় সেতু এপারের কালো চকচকে পীচের রাস্তার সঙ্গে ওপারে কাঁচা মাটির পথের মিতালি পাতিয়ে হা-হা করে সারাদিন হাসছে। এমনকি পোলের সাদা ছায়া পড়ে খালের শ্যাওলা রঙের জলটাও যেন আগের মতো নেই। বুনো বুনো ভাবটা চলে গেছে। কেমন একটা ফ্যাকাশে রঙ ধরেছে। যেন গাঁয়ের মেয়ে সবুজ ধনেখালি শাড়ি ছেড়ে সাটিনের ফ্রক চড়িয়েছে, কারোর ভালো লাগে, কারোর লাগে না।

হ্যাঁ, খালপোল মিতালি পাতিয়েছে এপারের সঙ্গে ওপারের। তাই কোনোদিন যাদের দেখা যায়নি, সেই সব জেলে ডোম বাগদীর ছেলেমেয়েরা ওপারের ধুলো বালি কাদা জঙ্গল আর মাটির সঙ্গে নুয়ে পড়া পাতার ঘর, হোগলার ডেরা ছেড়ে এখন হুটহাট পোলের উপর চলে আসে।হাঁটু পর্যন্ত ধূলা, ময়লা কাপড়ে লালচে রুক্ষ চুল, শুকনা মুখ নিয়ে ওরা পোলের ঝকঝকে কার্নিশের ওপর হাত রেখে নিচের জল দেখে হি-হি করে হাসে। ওরা খুশি। ওদের ভালো লাগছে এই পোল। ঠেলাগাড়ির ওপর কচু কুমড়ো ডাব কলা লাউশাকের আঁটি চাপিয়েচাষীরা দিব্যি পোলের উপর দিয়ে গড়গড় এপারের পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে মেটালড করা রাস্তায় নেমে আসে, তারপর ভালো ভালো বাজারগুলো যেদিকে আছে সেদিক ছুটে যায়। যেন রাতারাতি ওরা জেনে ফেলেছে এপারের কোন বাজারে তাদের ডাব মোচা কি কচু লাউশাক চড়া দামে বিক্রী হবে। ওদের মুখে এখন হাসি।

আবার মুখ কালো করে পোলের ওপর এসে দাঁড়ায়, ভুরু কুঁচকে সূর্যাস্তের লাল রঙ দেখতে দেখতে অপ্রসন্ন চোখে ময়লা কাপড় পরা ওপারের নোংরা মুখগুলিকে পাশে দেখে অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এমন মানুষও আছে। তারা এপারের বাসিন্দা। তাদের গায়ে ভাল জামা, পায়ে দামী জুতো। বিকেলের হাওয়া খেতে বেড়াতে বেড়াতে এখানে আসে। কিন্তু এদের সকলেই কিছু অসুখী নয়। নিজের গাড়ি আছে এমন সব সুখী মানুষেরা পোলের ভিড় পিছনে রেখে সোঁ করে ওপারের মাটির রাস্তায় নেমে যায়। প্রচুর ধুলো উড়িয়ে গাড়ি আরো দূরে চলে যায়। তারপর আর দেখা যায় না। হয়তো সবুজ বিকেল দেখতে পাখির কিচিরমিছির শুনতে ওরা বাগদীপাড়া জেলেপাড়া পার হয়ে বনের দিকে চলে গেল। পোলটাকে ওরা ধন্যবাদ জানায়।

কদিন পর্যন্ত পোলটাই একটা বিস্ময়, নতুনত্ব হয়ে রইল ওপারের মানুষ আর এপারের মানুষদের কাছে। তারপর যখন সেই নতুনত্ব যখন সকলের চোখে আস্তে আস্তে সয়ে গেল, স্বাভাবিক হয়ে এল, তারপর একদিন সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল এক অদৃশ্য শিল্পীর হাতের আঁকা নানা চিত্র পোলের গায়ে ফুটে উঠেছে। ফুল লতাপাতা মাছ পাখি। পোলের ঢালু দিকের চুনকামকরা সাদা অংশটায় শিল্পী ভারী যত্ন করে এইসব এঁকে রেখেছে। এ পাশের ঢালুর দিকেও লতাপাতা ফুল মাছ পাখির চিত্র আঁকা রয়েছে। ইঁটের গুঁড়ো নয়তো কাঠকয়লা ঘষে ঘষে চিত্রাঙ্কন করে গেছে শিল্পী। বোঝা যায় তার তুলি নেই, দোকান থেকে রঙ কিনে আনার সামর্থ্য নেই। কিন্তু সেটা বড় কথা না। অঙ্কনটাই আসল নয় চিত্রগুলিই এখানে বড়। তাছাড়া ইঁটের রংও রং, কয়লার রংও রং।

এপারের ভালো জামাকাপড় প্রা মানুষেরা মাথা নেড়ে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল একটা জিনিয়স। হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। হয়তো অনাদরে অবহেলায় থেকে নিজেকে তেমন করে প্রকাশ করতে পারছে না।কিন্তু তাতে কি, মহৎ শিল্পীর প্রতিভা নিয়ে যে লোকটার জন্ম হয়েছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আহা কি চমৎকার হাত!

ওপারের ময়লা কাপড় পরা নোংরা চেহারার মানুষগুলি বিচিত্র সব ছবি দেখে হি-হি করে হাসল, ‘পাগলা, মাথায় ছিট আছে বেটার। সারারাত কয়লা আর ইঁটের টুকরো ঘষে ঘষে এই সব কর্ম করে গেছে। খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না – দুনিয়ায় কত রকমের জীব আছে রে বাবা।’

জীবকে তারা দেখতে পায়না। গুণগ্রাহী বুদ্ধিমান শহুরে দর্শকদের কাছেও মহৎ শিল্পী অজ্ঞাত থেকে গেল। বেড়াতে এসে, কি ব্রিজ পার হবার সময় টাটা দু দণ্ড দাঁড়িয়ে গেছ লতাপাতা ফুল পাখি মাছ দেখে।

তিনদিন পর পোলের আর এক পাশে চিত্র ফুটে উঠল। এবার আর গাছ ফুল পাখি মাছ না। চন্দ্র সূর্য পর্বত সমুদ্র ঝরণা নদী। ওপারের মানুষগুলো আবার দাঁত বের করে হি-হি করে হাসল। ‘পাগলা বেড়ে কাজ পেয়েছে। সারা পোলটাই চিত্তির করে ফেলবে দেখছি!’

এপারের শহুরে মানুষরা মুগ্ধ বিস্ময়ে কাঠকয়লা ইঁটের টুকরো দিয়ে আঁকা চন্দ্র সূর্য সমুদ্র পর্বত দেখতে দেখতে আদিম সৃষ্টির কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘আহা যদি একবার দেখতে পেতাম।’ যেন দেখা পাওয়া মাত্র তারা তাকে বরণ করে নিত, সভা করে, তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিত, তারা খাওয়া প্রা সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে জনসাধারণের কাছ থেকে চাঁদা তোলার ধুম পড়ে যেত, সরকারী সাহায্যের জন্য আবেদন নিবেদন আরম্ভ হয়ে যেত।

‘কিন্তু পাগলা দেখা দেবে না।’ ওপারের অশিক্ষিত মানুষগুলো হি-হি করে হাসে। ‘পাগলা জেনে ফেলেছে, গা ঢাকা দিয়ে যতদিন চলা যায় ভাল। না হলে শহুরে বাবুর দল তাকে ধরে বেঁধে বলবে এটা আঁক ওটা এঁকে দে। ফাই-ফরমাস করে বেটার প্রাণচিত করে দেবে। নিজের মর্জিমত অমন চমৎকার চাঁদ ফুল সূয্যি চিত্রি করতে পারবে না। ওপারের নোংরা চেহারার মানুষগুলির এরকম একটা আশঙ্কা করবার কারণ আছে। কেননা তারা চোখের ওপর দেখেছে পোলের গায়ে চন্দ্র সূর্য মাছ পাখি দেখতে বাবুদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গেছে। ক্রমেই বাবুর সংখ্যা বাড়ছে, গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে কাগজওয়ালারা এসে যখন-তখন ফটো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সেদিন একটা লম্বা কালো গাড়ি চেপে ফ্রক পরা বেণী দোলানো এক ঝাঁক মেয়ে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেক চিত্রগুলি দেখে গেল।

‘লোকটা কখন এসব আঁকে রে?’ একটা আর একটিকে বলছিল। ‘অথচ আজ পর্যন্ত শুনেছি কেউ ওকে দেখতেই পেলে না!’

‘রাত্তিরে।’ গম্ভীর হয়ে আর একটি মেয়ে বলেছিল। ‘আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, সব মানুষে যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন এসে এঁকে যায়।’

‘তা হবে।’ চোখ তুলে আর একজন পোলের চার কোণার উঁচু থামগুলি দেখল। গম্বুজের মত চারটে থামের মাথায় বালব ঝুলছে। ‘সারা রাত আলো জ্বলে। আলোর নিচে দাঁড়িয়ে ও ছবি আঁকে।’

‘আলো না থাকলেও ও ঠিক এঁকে যেত। এই শিল্পী সাধারণ মানুষ না। ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন কোনো পুরুষ হবে।’ কথাটা বলেছিলেন এক বৃদ্ধ। মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে। পুরু চশমা নাকে ঝুলিয়ে স্কুলের মেয়দের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি গভীর মনোযোগের সাথে ছবি দেখছিলেন।

মেয়েরা তাঁর কথা শুনে চুপ করে গেল।

বৃদ্ধ হাত ঘুরিয়ে বক্তৃতা করলেন, ‘আমাদের এই সমাজ কি আর সমাজ আছে। সভ্যতার সংস্কৃতির বড়াই করে মরছি। অথচ যে দিকে তাকাবে দুর্নীতি ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। সত্যিকারের জ্ঞানী গুণী – বিশেষ করে যদি শিল্পী হন এই অধঃপতিত সমাজে নিজেকে ধরে রাখতে লজ্জাবোধ করেন। উঁ হুঁ এই সমাজের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি নিজের খাপ খাওয়াতে পারেন না। আমার তো মনে হয় এই শিল্পীও শুদ্ধচরিত্রের উন্নতমনা কোনো পুরুষ-ঋষিতুল্য ব্যক্তি – হয়তো তাঁর খাওয়া পরায় কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তা হলেও তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই নিজের শিল্পীসত্তাকের বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন।’

‘আমার মনে হয় আধুনিক সভ্যতাকে ব্যাঙ্গ করতে শিল্পী ইঁট কাঠকয়লা দিয়ে ব্রীজের গায়ে এসব ছবি এঁকে রাখছে। আমরা কৃত্রিম হয়ে গেছি, আমাদের সভ্যতাটা মেকী। সূর্য পাখি ফুল এঁকে শিল্পী বোঝাতে চাইছেন আমরা ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছি।’ একটি যুবক বৃদ্ধের সাথে কথা বলছিল। ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, লোকটি সাধক যোগী – বস্তুত সত্যিকারের শিল্পী তাই হয়। কেবল ছবি ও গানের ভিতর দিয়ে মানুষকে শিক্ষা দিতে মাঝে মাঝে এঁরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন।’

‘তা হবে।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। ‘কেবল আর্টিস্ট বললে এঁদের অপমান করা হয়। এঁরা প্রফেট।’

স্কুলের মেয়েরা কথাগুলির অর্ধেক বুঝল, অর্ধেক বুঝল না। ছবি দেখা শেষ করে আবার তারা দল বেঁধে কালো গাড়িতে গিয়ে চাপল। বৃদ্ধ পোল পার হয়ে অপেক্ষাকৃত মুক্ত নির্মল বায়ুসেবনের আশায় ওপারের দিকে হাঁটতে লাগলেন। যুবকটি শহরের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। ততক্ষণে নতুন দর্শকেরা এসে পোলের উপর ভীড় করে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু এটা কি হল। দিন পাঁচ ছয় পর এক সকালে দেখা যায় লতাপাতা ফুল পাখি চন্দ্র সমুদ্র পাহার মুছে দিয়ে অদৃশ্য চিত্রকর পোলের দু পাশটায় সাপ ব্যাঙ বিছা টিকটিকি আরশোলার ছবি এঁকে ভরে রেখেছে। ওপারের অশিক্ষিত মানুষগুলি আবার দাঁত বার করে হাসল। কেননা তারাই আগে দেখল ছবিগুলি। ডাব কুমড়ো লাউশাকের আঁটি বোঝাই ঠেলা গাড়ি নিয়ে সূর্য ওঠার আগে তারা পোলের উপর ছুটে আসে। ঠেলা থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে। কেননা ছবিগুলি নতুন। পাখি চাঁদ ফুল সমুদ্র ওদের চোখে পুরোনো হয়ে গিয়েছিল। সে সব দেখতে ইদানীং তারা বড় একটা গ্রাহ্য করেনি। সঙ্গের ছোট ছেলেটা তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে এক দুই করে গুনতে শুরু করে দেয়, তারপর ঠেলার কাছে ছুটে এসে চেঁচাতে থাকে, ‘মামা, চৌদ্দটা সাপ, আটাশটা ব্যাঙ, তিনকুড়ি আরশোলা, বাইশটা টিকটিকি হি-হি।’ তার হাসির সঙ্গে বড়রাও যোগ দেয়। ‘বাবুদের ভিড় বাড়ছে, তাই ব্যাটা মজা করতে সাপ ব্যাঙ চিত্তির করে রেখেছে, এবার কাগুজে ছোঁড়ারা এসে ফটোক তুলে নিয়ে যাক হা-হা।’

খালের ওধারের বাগদীপাড়ার ছেলেমেয়েরা দিনভোর পোলের এ মাথা ও মাথা ঘুরে সাপ ব্যাঙ আরশোলার ছবি দেখল। ‘পাগলা কাল রাতে গাঁজা টেনেছিল, না হলে গণ্ডায় গণ্ডায় হেলে সাপ চিত্তির করবে কেনে। আর সব কিনা কোলা ব্যাঙ, থপাস করে ছুটছে রে দিদি হি-হি।’

কিন্তু এবারেও শহরের ভদ্রপাড়ার মানুষেরা শিল্পীর নতুন সৃষ্টি দেখতে পোলের ওপর ভীড় করতে ভুল করল না।

‘মর্জি, শিল্পীর নতুন খেয়াল।’ ছবি দেখে তারা মন্তব্য করল।

‘সাধক শিল্পী-প্রকৃতির আর একটা দিক আমাদের চোখের সামনে উন্মোচন করে ধরল।’ সাদা চুল মাথার সেই বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে সেদিনের যুবকটি মন্তব্য করল।

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। চশমার পুরু লেন্‌স ভাল করে মুছে নিয়ে ফের সেটা নাকে তুলে দিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করলেন। ‘মানে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, আণবিক সভ্যতার বড়াই করে আমরা যতই লাফালাফি করি না কেন, ধ্বংসের মুখে এসে পৃথিবী থর থর করে কাঁপছে। শিল্পী বলতে চাইছে, দু পায়ের ওপর দাঁড়ানো মানুষের দিন শেষ হতে আর দেরী নেই, ওরা আবার আসছে, আসছে, আবার বুকের ওপর ভর দিয়ে চলা জীবদের রাজত্ব চলবে কয়েক কোটি বছর।’

কথা শুনে স্কুলের মেয়েগুলি গম্ভীর হয়ে গেল। এতক্ষণ ওরা বেশ মজা পাচ্ছিল সাপ ব্যাঙ টিকটিকি আরশোলা বিছার ছবি দেখে। যেন আনাজওয়ালাদের সঙ্গের সেই ছোট ছেলেটির মত এক দুই করে কটা ব্যাঙ কটা টিকটিকি গুনতে আরম্ভ করেছিল। আবহাওয়াটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যেতে ওরা সরে গেল। তবে তাদের আশা রইল আর একদিন হয়তো এসে দেখতে পাবে পোলের গায়ে বাঘ সিংহ বাইসন হাঙর কুমীর আঁকা রয়েছে।

ফাল্গুনের শেষ। এক রাত্রে জোর বৃষ্টি হয়ে গেল। পরদিন সকালে দেখা গেল বৃষ্টির জলে ধোয়ামোছা হয়ে নতুন ব্রীজটা আগের মত তকতকে ঝকঝকে গতে আছে। একটু আঁচড় নেই, একটু দাগ নেই কোথাও। কেউ কোনোদিন পোলের গায়ে চিত্রকর্ম করেছিল কে বলবে। কাজেই আর ভীড় নেই। ওপারের মানুষেরা এপারে এল। বাস দেখল রিকশা দেখল দোকানপাট দেখল, ঝকঝকে পোশাকের শহুরে মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এপারের কিছু মানুষ ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে খালের ঘোলা জল দেখল, খড় বোঝাই নৌকা দেখল, আকাশ দেখল – কিছু মানুষ ব্রীজ পার হয়ে পাখি দেখল, তারপর আবার শহরের দিকে ফিরে এল। পোল দেখতে, পোলের গায়ে বিচিত্র ছবি দেখতে আজ কেউ দাঁড়ায় না। যেন হাজার বছরের পুরোনো এই সেতু – এর আবার নতুনত্ব কি, এর দিকে তাকাবার আছে কি। দুপুরের গনগনে দোদ মাথায় নিয়ে নিঃসঙ্গ ব্রিজটা মানুষের স্বভাবের কথা চিন্তা করে ঠোট টিপে হাসছিল হয়তো।

অবশ্য পরদিনই সকালবেলা আবার সকলকে চোখ তুলে পোলের দিকে তাকাতে হল। সাপ ব্যাঙ না, হাঙর কুমির বাঘ বাইসন না – আনাজওয়ালাদের সেই ছেলেটা গুণে গুণে দেখেল এধারে কুড়িটা ওধারে কুড়িটা মানুষের মুখ এঁকে রেখে গেছে কে। ‘উঁহুঁ, একটাও পুরুষ মানুষের মুখ না, সব মেয়ে মানুষের মুখ হা-হা।’

ওপারের বাগদী আর জেলেপাড়ায় হেসে লুটোপুটি।

‘বেটার বৌ পালিয়েছে, তাই না মনের দুঃখে ওই কর্ম করেছে। রাতভর মেয়েছেলের মুখ চিত্তির করে গেছে, হি-হি।’

যেন এতকাল পর লোকটা নিজেকে ধরা দিয়েছে, যেন আজ বোঝা গেছে কী দুঃখ বুকে নিয়ে সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। হুঁ, এ সব ব্যাথা নিয়েই তো মানুষ কবিতা লেখে, গান গায়। বিরহী শিল্পীর ছবি আঁকাটাও তাই। তার উপর কিনা –

চোখ বড় করে এপারের সুশ্রী চেহারার সুন্দর পোশাকের মানুষগুলি এপাশে কুড়িটা মুখ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। নারীমুখ ছাড়া আর কি ? বলয়াকৃতি, পূর্ণ চাঁদের আকৃতি, ডিমের আকৃতি, শঙ্খের আকৃতি। নরম রেখার সব মুখ পর পর সাজান।

‘দেখছেন না, ওদের চোখে তৃষ্ণা, অধরে কামনা।’ পক্ককেশ বৃদ্ধের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে সেই যুবক মৃদু মৃদু হাসে। ‘আমার মনে হয়, আমার তো ধারণা হচ্ছে লোকটা ব্যার্থ প্রেমিক সংসার ভালো লাগল না। এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে-’

কথা শেষ করতে দেন না বৃদ্ধ। যেন আজ তিনি ক্ষুব্ধ, ব্যথিত।

‘কিন্তু তা হলেও এতগুলি নারীমুখ এমন প্রকাশ্য স্থানে এঁকে রাখার দরকার ছিল না। এটা অশোভন। এখনি হয়তো স্কুলের মেয়েরা ছুটে আসবে পোলের গায়ে আজ কি আঁকা রয়েছে দেখতে।’

‘প্রেমে ব্যর্থ হয়ে লোকটা সিনিক হয়ে গেছে।’ যুবক ঢোক গিলল, তারপর আস্তে বলল, ‘আমার তো ধারণা শিল্পী বহু নারীর প্রেমপ্রার্থী হয়েছিল। কিন্ত একজনও একটি মেয়েও তার উপর সদয় হয়নি।’

‘তা হবে, তা হওয়া আশ্চর্য না।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। ‘এবং এই কারণে যে লোকটার মাথার দোষ হয়েছে এটাও এখন বুঝতে পারছি।’

‘আমার তাই মনে হয়। তাই সেদিন এতগুলো সাপ ব্যাঙ আরশোলা টিকটিকি এঁকে রেখেছিল, তাই সেদিন দেড় হাজার ফুট লম্বা ব্রিজটা চন্দ্র সূর্য সমুদ্র পর্বত এঁকে ভরে রেখেছিল। পাগল।’

‘এবং বিকৃতদর্শন।’ বৃদ্ধ কঠিন গলায় মন্তব্য করলেন। ‘তার দিকে কোনো রমণী মুখ তুলে তাকাতেও নিশ্চয় লজ্জা পায়। আর – আর সেই রাগে দেখছেন না। সব কটা মুখ লালসাবিকৃত করে আঁকা হয়েছে – আমার তো ইচ্ছা করছে সবগুলো মুখ মুছে ফেলা হোক।’

ভিড় বাড়ছে। গুঞ্জন বাড়ছে। স্কুলের মেয়েদের নিয়ে লম্বা গাড়িটা এসে গেছে। কিন্তু তারা আর গাড়ি থেকে নামল না। বৃদ্ধ গাড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নিষেধ করলেন, ‘মা আজ তোমরা ফিরে যাও, এসব ছবি তোমাদের জন্য না।’ কিন্তু তবু যেন দু একটি কৌতুহলী মুখ জানলার বাইরে তাকাতে চেয়েছিল। গাড়ি তৎক্ষণাৎ সরিয়ে নিতে যুবক তারস্বরে ড্রাইভারকে আদেশ করতে গাড়ি ব্রীজের নীচে নেমে গেল।

‘তাই বলছিলাম ভাই, দুর্নীতি, চতুর্দিকে পাপ।‘ বৃদ্ধ ঘামছিলেন, উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। ‘একটু হাওয়া খেতে ব্রীজের দিকে বেড়াতে আসি। এখন দেখছি তাও বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে যদি পোলের গায়ে কেউ চিত্রবিদ্যা ফলাতে থাকে তো আমরা যাই কোথায়।’

‘আপনার মশাই বাড়াবাড়ি।’ যেন বুড়োমতো এক ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন। ‘না হয় শখ করে কটা মুখ এঁকেছে – তাতে এমন কি আপত্তিকর –’

ভদ্রলোককে কথা শেষ না করতে দিয়ে যুবকটি চিৎকার করে উঠল। ‘আপনি চুপ করুন, আপনি থামুন, আপত্তি করার যথেষ্ট কারণ আছে। একটা মুখ না, চল্লিশটা মেয়েমুখ যদি কেউ রাস্তার উপর, একটা পোলের গায়ে ইঁট কাঠকয়লা দিয়ে এঁকে রাখে তো বুঝতে হবে, যে এসব এঁকেছে কেবল তারই রুচি বা মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেনি – জনসাধারণের মধ্যে এই বিকৃতির চালান দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে রাত জেগে সে এসব কাজ করে গেছে।’

ভদ্রলোক চুপ। বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে রুমাল বার করলেন, যুবকটিও বার করল। তারপর দু’জনে লেগে গেলেন ছবিগুলি মুখে দিতে। ‘এটা আমার একলার না, সকলের দায়িত্ব।’ বৃদ্ধ থেকে থেকে ঘাড় ফিরিয়ে উপস্থিত শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, ‘সুতরাং সকলেরই দৃষ্টি রাখতে হবে, যেন আর কোনোদিন এখানে এসব মুখ আঁকা না হয়।’

দু’জনের দেখাদেখি আরও কয়েকজন রুমাল বার করে ওপাশের মুখগুলি মুছতে লেগে গেল। দশ মিনিটের মধে পোল খালি করে দর্শকের দল সরে যায়। পড়ন্ত রোদের আভা গায়ে নিয়ে ব্রিজটা যেন আলস্যের হাই তোলে। আজ আবার তার দিকে কেউ তাকাবার নেই। ঘোলা জলের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে ধরে খালপোল খালের বুকের কাঠবোঝাই নৌকাটির মন্থর গতি দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠে।

একটানা তিনদিন এভাবে কাটল। কোনো ছবি নেই, কোন দর্শক নেই, কোনো উত্তেজনা নেই। আনাজের গাড়িগুলি গড়গড় করে পোল পার হয়ে শহরের পীচের রাস্তায় নেমে যায়। পোলের ওপর তারা কোনোদিন দাঁড়িয়েছিল মনে করতে পারে না। জেলে আর বাগদীপাড়ার মানুষগুলো শহরের আলো দেখে গাড়ি দেখে – সময় সময় গুটিগুটি পোল পার হয়ে এধারের সিনেমাঘরের দেয়ালে আটকান রঙিন ছবিগুলির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বাবুরা হাওয়া খেতে পোলের উপর উঠে জল দেখেন, আকাশ দেখেন। যাদের গাড়ি আছে, তারা ব্রীজ পিছনে রেখে ওপারের ঠাণ্ডা নরম মাটির রাস্তায় নেমে যান। গাঁয়ের বিকেল, বনের পাখির ডাক তাদের প্রিয়। খালপোল না।

রাত্রে বিশাল চাঁদ দেখা দিল আকাশে। চার কোণার গম্বুজের মাথায় ইলেট্রিক বালবগুলিও পোলের গায়ে কম আলো ছড়াল না। কিন্তু আজ কি আর লোকটা ছবি আঁকবে। কেউ কেউ ভাবল, নিশ্চয় তার এমন যত্ন করে আঁকা চিত্র মুছে দেওয়াতে শিল্পী অপমান বোধ করছে। অভিমানে সে আর এদিক মাড়াবে না। কে জানে হয়তো অন্য কোথাও আর কোনো পোলের গায়ে কি বাড়ির দেওয়ালে সে ছবি আঁকছে।

কেউ কেউ ভাবল, কিন্তু তাদের সেই ধারণা যে কত ভুল সকালের লাউ কুমড়ো গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে পোলের উপর উঠে গাঁয়ের মানুষগুলো সকলের আগে তার প্রমাণ পেল। চিত্রগুলির ওপর চোখ পড়তে তারা চোখ ফিরিয়ে নিল। সঙ্গের ছোট ছেলেটি হেসে ফেলেছিল, বড়দের ধমক খেয়ে বেচারা চুপ করে গেল।‘শালার কাণ্ডকারখানা দেখ – ইস্‌ কী কুচ্ছিত চিত্তির করে গেছে সারাটা পোলের গায়ে।’ যেন তারা নিজেরাই লজ্জা পেল ছবিগুলির দিকে তাকাতে। ঠেলা চাপিয়ে তাড়াতাড়ি তারা পোল থেকে নেমে গেল। তারা নেমে গেল, কিন্তু অশ্লীল ছবির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে সে সব উপভোগ করার মানুষের অভাব হল কি।

জেলে আর বাগদীপাড়ার মানুষগুলি হেসে কুটিকুটি।

এপারের বিড়ির দোকান পান দোকানের মানুষগুলি হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ল।

‘কালকের শোধ তুলতে পাগল এসব এঁকে রেখেছ। হি-হি।’

যেন খবরটা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। অশ্লীল ছবির গন্ধ পেয়ে মাছির ঝাঁকের মত মানুষ পোলের উপর এসে ভিড় করতে লাগল। পোলের দু’পাশে, দু’দিকের ঢালু থেকে আরম্ভ করে উলঙ্গ নরনারীর মিছিল দেখতে ভদ্র অভদ্র শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে রীতিমত ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি আরম্ভ হয়ে গেল। কেউ ঠোঁট টিপে হাসল- ছোকরার দল হাততালি দিয়ে শিস্‌ দিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে সিটি মেরে উল্লাস প্রকাশ করল।‘এতকাল পর ছবির মত ছবি এঁকে গেছে বেটা। তার গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দিতে হয়। আহা। যদি একবার দেখা পেতাম চিত্রকরের!’

‘মেডেল না, জুতোর মালা।’

উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে সকলে ঘাড় ফেরাল। যুবকের সঙ্গী সেই বৃদ্ধ এসে পৌছায়নি! তার আসতে বিকেল। বস্তুত এসব দেখে বুড়োমানুষ্টা কি করবে অনেকে বলাবলি করছিল। ইতিমধ্যে যুবকটি পকেট থেকে রুমাল বের করে ফেলেছে। কিন্তু করলে হবে কি, চায়ের দোকান বিড়ির দোকানের মানুষগুলি হৈ-হৈ করে উঠল, ‘মশাই সবুর করুন সবুর করুন, এখনি সব মুছে ফেলা কেন – এমন চমৎকার চিত্র, আর একটু দেখে নি। আপনিও চোখ ভরে দেখে নিন। আপনার ক্ষমতায় কুলোবে আঁকবার।’

তারা দলে ভারি। রুমালটা পকেটে ভরে যুবক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কতক্ষণে পুরু চশমা চোখে পাকা চুল মাথায় সেই বৃদ্ধ এসে যাবেন, তার অপেক্ষা করতে লাগল, আর অশ্লীল ছবিগুলির উপর চোখে না পড়ে এমনভাবে ঘুরিয়ে, দাঁড়িয়ে খালের জল দেখতে লাগল। এদিক হাসি শিস অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ঠেলাঠেলি বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলত। হঠাৎ সব থেমে গেল, সবাই অন্তত দু মিনিটের জন্য চুপ করে থেক লোকটাকে দেখল। পাগল? দার্শনিক? সাধক? ভণ্ড? মাথায় ধুলোবালি মাখা ঝাকড়া চুল, কোটরগত চক্ষু, কিন্তু চোখ দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, পরনে ছেঁড়া চট, আর বগল থেকে আরম্ভ করে কব্জি পর্যন্ত দুটো হাতে লাল সাদা নীল হলুদ ন্যাকড়ার টুকরো জড়ানো। হাতে একটা টিনের কৌটো। যার সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে, তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর হাতের কৌটো নেড়ে বিড়বিড় করছে, ‘হেল্‌প, হেল্‌প।’

ব্যাপার কি? শিক্ষিত অশিক্ষিত ভদ্র অভদ্র, সকল শ্রেণীর দর্শকের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। কে ও?

‘কে, বুঝতে পারছেন না?’ একজন আঙুল দিয়ে লোকটার খালি খোলা পাঁজর-বের-হওয়া শীর্ণ বুকটা দেখিয়ে দেয়। উল্কি করা উলঙ্গ এক নারীমূর্তি। ‘বুঝতে পারছেন না, এই তো সেই ব্যর্থ প্রেমিক-লুকিয়ে থেকে, লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে চাঁদ সূর্য ফুল পাখি আর নারীমূর্তি এঁকে এঁকে যে বুকের জ্বালা কমাতে চাইছে। তার বুকেও সেই ছবি আঁকা রয়েছে আর কি প্রমাণ চান।’

যেন সকলে একসঙ্গে ঢোক গিলল, অবাক হল, উত্তেজিত হল, ক্রুদ্ধ হল, খুশী হল প্রেমিক শিল্পীর দর্শন পেয়ে।

‘ও আজ হঠাৎ দেখা দিলে বড় ? কি চাইছে ও?’

‘আজ শেষ দিন, সে জানে এখানে আর তার ছবি আঁকা হবে না, নীতিবাগীশের দল এখনি সব ছবি মুছে, হয়ত কাল থেকে এখানে পাহারা বসাবে, পুলিশ মোতায়েন করা হবে – আজ এসেছে সাহাজ্য চাইতে, তার শ্রমের মূল্য, দক্ষিণা –শিল্পীর প্রেমের ক্ষুধা আমরা মেটাতে পারি না, কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো মেটাতে পারি, আর সেই দায়িত্ব আমাদের দিন, সকলে দু-চার আনা করে –

‘ হেল্‌প হেল্‌প’ – উন্মাদ শিল্পী কৌটো নাড়ছে আর মিটিমিটি হাসছে। পোলের এমাথা থেকে ওমাথার দিকে সে এগিয়ে যায় আবার ফিরে আসে।

‘উঁহুঁ, সাহাজ্য-টাহাজ্য পরে হবে!’ সেই যুবক চেঁচিয়ে উঠল। আগে জানা দরকার কোথায় সে থাকে, কি পরিচয়, আর এসব অশ্লীল চিত্র আঁকার উদ্দেশ্য কি – পোলটা তো তার ঘর বাড়ি নয়, স্টুডিও নয় যে, যা খুশি এঁকে রাখলে চলবে, দশটা পুরুষকে, দশটা মেয়েছেলেকে এই ব্রীজের উপর দিয়ে এপার-ওপার করতে হয়।’

‘আচ্ছা, শিল্পীর আবার পরিচয় জিজ্ঞাসা করা কেন।’

একজন একটু রুষ্ট গলায় বলল, ‘শিল্পই তার পরিচয়। বরং প্রশ্ন করুন, এতকাল কোথায় ছিল, যদি এখানে থাকে আর ছবি আঁকতে দেওয়া না হয় তো এর পর কোথায় গিয়ে শিল্পচর্চা করার ইচ্ছা রাখে।’ কথাটার মধ্যে একটু খোঁচাও ছিল।

যুবক ক্রুদ্ধ হয়।

‘কেন লেংটা মেয়েমানুষের ছবি দেখতে আপনিও সেখানে ছুটে যাবেন নাকি।’

‘তা না-হয় গেলাম। ছবি দেখতে দোষ কি- এ তো জলজ্যান্ত কোনো মেয়েছেলে কাপড়-চোপড় ছেড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না। কেন, আপনি যে বড় ক্ষেপে যাচ্ছেন, পুরীর মন্দিরে গিয়ে দেখুন না, কত উলঙ্গ ছবি চারদিকে আঁকা রয়েছে।’

‘সেটা মন্দিরে মঠে চলে কলকাতার রাস্তায় চলে না।’

‘কোথাও চলে না, যে-যুগে মঠে মন্দিরে ওসব আঁকা হ’ত, সেটা এ-যুগ নয়, আজ কোনো মন্দিরের গায়ে এসব চিত্র আঁকতে গেলে মানুষ আপত্তি জানাবে। কেন, এক সময়ে তো মানুষ উলঙ্গ, অর্ধ- উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াত, এখন কি তা চলে? বলুন, আমার কথার উত্তর দিন।’

সবাই চমকে ওঠে। সেই পক্ককেশ স্থলিতদন্ত বৃদ্ধ। যেন কার কাছে খবর পেয়ে দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে ছুটে এসেছে। উত্তেজনায় কাঁপছে। ‘বলুন, আমার কথার উত্তর দিন, যে-রাস্তায় এসব চিত্র থাকে, আপনার আপনাদের ছেলেমেয়েদের হাত ধরে সে-রাস্তা কী করে পার হবেন? চুপ করে আছেন কেন সব এখন?’

একটা চাপা গুঞ্জন উঠল।

‘না, না, বেটাকে আচ্ছা শিক্ষা দিয়ে দিন – ভবিষ্যতে যাতে আর -’ একজন বলল, ‘এখন কত বড় বড় মেয়েরা স্কুলে কলেজে পড়ছে!’ আর একজন সায় দেয়। ‘এখনি ছবিগুলি মুছে ফেলা হোক।’

‘হ্যাঁ এই মুহূর্তে – আর বেটাকে ভালো করে শিক্ষা দেয়া হোক, যাতে আর কোনোদিন এপথে পা না বাড়ায়।’ একসঙ্গেঅনেকগুলি কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বোঝা গেল, এ-পক্ষ এখন দলে ভারি। যারা হাসছিল, শিস দিচ্ছিল, অশ্লীল ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ততোধিক অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছিল, তারা চুপ, যেন লজ্জায় তারা অধোবদন হয়ে আছে। দু-একজন ইতিমধ্যে সরে গেছে।

‘এই, তুই কোথায় থাকিস?’ বৃদ্ধের সঙ্গী সেই যুবক, পাগলের মত দেখতে, অজ্ঞাতপরিচয় শিল্পীর একটা হাত চেপে ধরল।‘কোথায় তোর আস্তানা?’

‘হি-হি-‘ পাগলের মতো লোকটা হাসে, হাত তুলে আকাশ দেখায়। যেন আকাশে তার ঘরবাড়ী।

বৃদ্ধ হুঙ্কার ছাড়ল।

‘এই বেটা, পাগলামি রাখ্‌ – তুই কোথায় থাকিস?’

‘হেল্‌প হেল্‌প।’

‘তোমার দাঁত ভেঙে দেব।’ যুবক থাবা মেরে তার হাতের কৌটো ফেলে দেয়।

‘হেল্‌প হেল্‌প।’

‘একটা চাঁটি মারুন না।’ পিছন থেকে আর একজন গর্জন করে উঠল। ‘বদ্ধ উন্মাদ।’

‘আমার তো মনে হয় পাগলটাকে যেন পোলের ওপারে একদিন দেখেছিলাম।’ একজন হঠাৎ বলে উঠল।

‘হ্যাঁ আমিও যেন দেখেছিলাম।’ আর-একজন।

‘না, না, ও কথা বলবেন না বাবুরা।’ পোলের ওপারের মানুষগুলি সমস্বরে প্রতিবাদ করে উঠল। ‘শহুরে পাগল ছাড়া ওরকম চিত্তির করবে কে।’

‘না গো কর্তা, আমরা নেখাপড়া জানি না, আমাদের পাড়ার কোন মানুষ ছবি আঁকতে জানে না।’ জেলেপাড়ার বাগদীপাড়ার পুরুষ নারী কলরব করে উঠল।

‘ছবি আঁকতে লেখাপড়া জানতে হয় না।’ অশিক্ষিত মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ ভেংচি কাটেন। ‘পাথরের গায়ে, গাছ খুদে আদিম মানুষেরা নানা চিত্র করে গেছে –জংলী বর্বর ছাড়া এসব প্রকাশ্য জায়গায় এসব আর আঁকবে কে –নির্ঘাত এ তোদের লোক।’

‘উঁহুঁ উঁহুঁ –শহুরে মানুষ।’ ওরা হৈ-হৈ করে উঠল।

এদিকে সেই যুবক উন্মাদ শিল্পীর মাথায় চাঁটি মেরেছে। দাঁড়িয়ে থাকলে আরো মার খেতে হবে, ভয় পেয়ে লোকটা পোলের ওদিকে ছুটে যাচ্ছিল। জেলে আর বাগদীরা পথ ঘুরে দাঁড়াল। ‘এই এই শালা?’

ওদিকে বাধা পেয়ে লোকটা এদিকে ছুটে আসে। শহরের সব মানুষ একসঙ্গে বাধা দেয়, ‘খবরদার এদিকে পা বাড়ালে মাথা ভেঙে দেব।’

পাগল আবার ওদিকে ছোটে, তার শীর্ণ পা দুটো কাঁপছে, চকচকে চোখদুটো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চাপা আর্তনাদের মত একটা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে।

‘এই বেটা!’ বাগদীদের একজন লোকটার কোমরে লাথি মারল। হুমড়ি খেয়ে সে পড়ে গেল। ঠোঁট কাটল। ঠোঁটের রক্তে বুকের উল্কি করা নারী মূর্তি লাল হয়ে উঠল। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে পাগল আবার ছোটে এদিকে ছুটে আসে। যেন বাবুদের দিকেই হঠাৎ সরু মত একটা রাস্তা আবিষ্কার করে সে বোঁ করে দৌড় দিয়ে ঢালু বেয়ে খালের ভিতর নেমে যায়, তারপর জলে ঝাঁপ দেয়। আর দেখা যায় না পাগলকে। ডুব দিয়ে ও কোনদিকে গেল, কে জানে। যেন জানার দরকার নেই। ততক্ষণে পুলিশ এসে গেছে। বৃদ্ধের সঙ্গী সেই যুবক হাত নেড়ে পুলিশকে কি বোঝায়। আঙুল দিয়ে পোলের গায়ে অশ্লীল চিত্র দেখায়।

‘পাগলা-মাথা খারাপ আছে।’ হাতের লাঠি ঠুকে ঠুকে পুলিশটা দাঁত বার করে হাসে আর পোলের গায়ে চিত্র-করা উলঙ্গ নরনারীর চিত্র মিছিল দেখে।কিন্তু বেশীক্ষণ দেখতে পায় না। বাবুরা রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে দশ মিনিটের মধ্যে সব ছবি মুছে দিল। জেলে আর বাগদীপাড়ার মানুষেরা কি যেন বলাবলি করতে করতে পোলের উপর নেমে গেল। বাবুরা নেমে এলেন শহরের দিকে।

খালপোল আবার শূন্য নীরব। কিন্তু পোলটা আজ আর দুপুরের রোদলাগা খালের জল বা জলের উপর কাঠ বোঝাই বিশাল নৌকাটার মন্থরগতির দিকে তাকিয়ে নেই। তার দৃষ্টি আর-একটু-দূরে খালের এপারের পীচ ঢালা একটা সরু গলির মুখে নিমগাছের ছায়ায় ঢাকা টিনের ঘরের দিকে। কেননা, নিচু চালের টিনের ঘরের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উমেশও নির্নিমেষ চোখে পোলটাকে দেখছে। বলা চলে উমেশের সঙ্গে খালপোলের একটা চোরা দৃষ্টি বিনিময় হল।

উমেশ ঠোঁট টিপে হাসল। কিন্তু পোল হাসে না। গম্ভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।উমেশ অবশ্য তাতে দুঃখ পায় না। জানলা থেকে সরে গিয়ে তক্তপোশের তলা থেকে জংধরা পুরোনো টিনের সুটকেসটা টেনে বার করে।

‘বেরোচ্ছ নাকি?’ বৌ শুধায়।

‘হুঁ। উমেশ উত্তর করে।

‘আজ বেচতে পারবে এক-আধটা?’

‘মনে হয়, একটা ভাল বাজার পেয়ে গেছি।’ বৌয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে উমেশ হাসে।

বৌ চিবুক নাড়ে।

‘তা বলে আগেই মেয়েটেয়ের ছবিগুলো বের করো না।’

‘না, না, ’ উমেশ মাথা নাড়ে। ‘আগে কালী দুর্গা, বা পরমহংস-টংস যা আঁকা আছে ঝুলিয়ে দেব, তারপর কিছু ল্যাণ্ডস্কেপ, তারপর না-হয়-’ চোরা চোখে পোলটাকে একবার দেখে নিয়ে উমেশ ঢোক গিলল। বৌ ঢোক গিলল। তারপর অস্পষ্ট অস্ফুট গলায় বলল, ‘দেখা যাক।’

রোদটা এখনও চড়া। একটু ছায়া, একটু বিকেলের জন্য উমেশ অপেক্ষা করতে থাকে যদিও।

Sunday, December 24, 2017

সুন্দরম্
সুবোধ ঘোষ

সমস্যাটা হলো সুকুমারের বিয়ে। কি এমন সমস্যা! শুধু এক মনোমত পাত্রী ঠিক করে শুভলগ্নে শাস্ত্রীয় মতে উদ্বাহ কার্য সমাধা করে দেওয়া; মানুষের একটা জৈব সংস্কারকে সংসারে পত্তন করে দেওয়া। এই তো!

কিন্তু বাধা আছে — সুকুমারের ব্রহ্মচর্য। বার বছর বয়স থেকে নিরামিষ ফোঁটা তিলক ধরেছে সে। আজও পায়ে সেধে তাকে মুসুরির ডাল খাওয়ান যায় না। সাহিত্য কাব্য তার কাছে অস্পৃশ্য। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া জীবনে সে পড়েছে ক’খানি যোগশাস্ত্রের দীপিকা। বাগানের নির্জন পুকুরঘাটে গভীর রাতে একাগ্র প্রাণায়ামে কতবার শিউরে উঠেছে তার সুষুম্ন। প্রতি কুম্ভকে রেচকে সুকুমার অনুভব করেছে এক অদ্ভূত আত্মিক শক্তির তড়িত্স্পর্শ, শ্বাসে প্রশ্বাসে রক্তে ও স্নায়ুতে।

সুকুমার চোখ বুজলেই দেখতে পায় তার অন্তরের নিভৃত কন্দরে সমাসীন এক বিরাগী পুরুষ। আবিষ্ট অবস্থায় কানে আসে, কে যেন বলছে — মুক্তি দে, মুক্তি দে। জপ ছেড়ে চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পায়, কার এক গৈরিক উত্তরীয় ক্ষণিকের দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে।

সুকুমার বন্ধুদের অনেকবার জানিয়েছে — বাস্, এই এগজামিনটা পর্যন্ত, তার পর আর নয়। হিমালয়ের ডাক এসে গেছে আমার।

সুকুমারের বাবা কৈলাসডাক্তার বলতেন — প্রোটিনের অভাব। পেটে দুটো ভালো জিনিস পড়ুক, গায়ে মাংস লাগুক, এসব ব্যামো দু’দিনেই কেটে যাবে। কত পাকামি দেখলাম।

কিন্তু মা, পিসিমা, ছোটোবোন রাণু আর ঝি, তাদের মন প্রবোধ মানে না।

সকলে মিলে চেপে ধরলো কৈলাসডাক্তারকে — যত শীগগির পার পাত্রী ঠিক করে ফেল আর দেরী নয়!

ঝিয়ের কোঁদল তো লেগেই আছে — ছি ছি. সংসারে থেকেও বনবাস। ছোটজাতের ছোটঘরেও কেউ এমন কসাইপনা করেনা বাপু।

সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা হলো। কৈলাসবাবু পাত্রী দেখবেন। ভগ্নীপতি কানাইবাবু সুকুমারের মতিগতির চার্জ নিলেন। যেমন করে পারেন কানাইবাবু সুকুমারকে সংসারমুখো করবেন।

পাশের খবর বেরিয়েছে। কানাইবাবু সুকুমারকে দিয়ে জোর করে দরখাস্তে সই করালেন! নাও, সই কর। মুন্সেফী চাকরি ঠাট্টার নয়! সংসারে থেকেও সাধনা হয়। ঐ যাকে বলে, পাঁকাল মাছের মত থাকবে। জনকরাজা যেমন ছিলেন।

বাড়ির বিষণ্ণ আবহাওয়া ক্রমে উত্ফুল্ল হয়ে আসছে। কৈলাসবাবু পাত্রী দেখে এসেছেন। এখন সমস্যা সুকুমারকে কোন মতে পাত্রী দেখাতে নিয়ে যাওয়া। কানাইবাবু সকলকে আশ্বস্ত করলেন — কিছু ভাববার নেই; সব ঠিক হো যায়েগা।

সংসারের ওপর সুকুমারের এই নির্লেপ, এখনও কে যায়নি ঠিকই! তবু একটা চাঞ্চল্য, আচারে আচরণে রক্তমাংসের মানুষের মেজাজ এক-আধটুকু দেখা দিয়েছে যেন।

তবু একবার পড়ার ঘরে কানাইবাবুর সঙ্গে সুকুমারের একটা বচসা শোনা গেল। বাড়ির সবারই বুক দুরদুর করে উঠলো। ব্যাপার কি ?

কানাইবাবুর কথার ফাঁদে পড়ে সুকুমারকে উপন্যাস পড়তে হয়েছে, জীবনে এই প্রথম। নাভিমূলে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে, অগুরু পুড়িয়ে ঘরের বাতাস পবিত্র করে নিয়ে অতি সাবধানে পড়তে হয়েছে। বলবান ইন্দ্রিয়গ্রাম, কি হয় বলা তো যায় না।

কিন্তু উপন্যাস না নরক। যতসব নীচ রিপুসেবার বর্ণনা। সমস্ত রাত ঘুম হয়নি।, এখনও গা ঘিন ঘিন করছে।

সুকুমার বলে — আপনকে এবার ওয়ার্ণিং দিয়ে ছেড়ে দিলাম কানাইবাবু।

মানে অপমানে পূর্ণ উদাসীন কানাইবাবু বললেন — আজ সন্ধ্যায় সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাব তোমায়। যেতেই হবে ভাই। তোমার আজ্ঞাচক্রের দিব্যি। তা ছাড়া ভাল ছবি, ধ্রুবের তপস্যা। মনটাও তোমার একটু পবিত্র হবে।

কানাইবাবুর এক্সপেরিমেন্ট বোধহয় সার্থক হয়ে উঠলো। ক’দিন পরেই দেখা গেল, সুকুমার কাব্য পড়ছে, কোন্ এক আখড়ায় গিয়ে মাথুর শুনে এসেছে, ঘন ঘন সিনেমায় যাচ্ছে। এদিকে অ্যাপয়েনমেন্ট পত্রও চলে এসেছে।

কিন্তু অনাসক্তির ঘোর পূর্ণ কাটেনি। আজকাল সুকুমারের অতীন্দ্রীয় আবেশ হয়। জ্যোত্স্না রাতে বাগানে একা বসে বসে নেবুফুলের সুগন্ধে মনটা অকারণে উড়ে চলে যায় — ধূলিধূসর সংসারের বন্ধনে ছেড়ে যেন আকাশের নীলিমায় সাঁতার দিয়ে বেড়ায়! একটা বিষণ্ণ সুখকর বেদনা। কিসের অভাব! কাকে যেন চাই! কে সেই না পাওয়া ? দীর্ঘশ্বাস চাপতে গিয়ে লজ্জা পায় সুকুমার।

রাত করে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরবার পথে কানাইবাবু সুকুমারকে জিজ্ঞেস করলেন — নাচটা কেমন লাগলো ?

সুকুমার সহসা উত্তর দিল না। একটু চুপ করে থেকে বললো — কানাইবাবু ?

— কি ?

— মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

— নীশ্চয়। কালই চল বারাসত। যাদব ঘোষের মেয়ে বনলতা। তোমার মেজদি যেতে লিখেছে। আর বাবা তো আগেই দেখে এসেছেন।

উকীলের মহুরী যাদব ঘোষ। বংশ ভাল তার মেয়ে বনলতা দেখতে ভালই। যাদব ঘোষ অল্প পণে সত্পাত্র খুঁজছেন।

মেজদি এক বছর পনের বয়েসের মেয়েকে হাত ধরে সামনে টেনে নিয়ে এলেন। — ভাল করে দেখে নে সুকু, মনে যেন শেষে কোন খুঁতখুঁত না থাকে।

যাত্রাদলের রাজকুমারীর মত মেয়েটাকে যতদূর সম্ভব জবরজং করে সাজানো হয়েছে। বিরাট একটা বেনারসী শাড়ী আর পুরু সাটিনের জ্যাকেট। পাড়ার মেয়েদের কাছ থেকে ধার-করা চুড়ি রুলি বালা ও অনন্ত, কনুই পর্যন্ত বোঝাই করা দু হাত। ঘামে চুপসে গেছে কপালের টিপ, পাউডারের মোটা খড়ির স্রোত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গলার ওপর। মেয়ে দম বন্ধ করে, চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যেন যজ্ঞের পশুর মত এসে দাঁড়ালো।

বনলতার শক্ত খোঁপাটা চট করে খুলে, চুলের গোছা দু’হাতে ধরে মেজ বললেন — দেখে নে সুকু। গাঁয়ের মেয়ে হলে হবে কি? তেলচিটে ঘাড় নয়, যা তোমাদের কত কলেজের মেয়েদের দেখেছি। রামোঃ।

মেজদি যেন ফিজিওলজি পড়াচ্ছেন। বনলতার থুতনিটা ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখালেন। চোখ মেলে তাকালে বললেন — ট্যারা কানা নয়। পায়চারি করালেন — খোঁড়া নয়। সুকুমারের মুখের সামনে বনলতার হাতটা টেনে আঙুলগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখালেন — দেখছিস তো, নিন্দে করার জো নেই।

দেখার পালা শেষ হলো। বাড়ি ফিরে কানাইবাবু জিজ্ঞাসা করলেন — কি যোগীবর, পছন্দ তো ?

সুকুমার চুপ করে বসে রইল। মুখের চেহারা প্রসন্ন নয়। কানাইবাবু বুঝলেন, এক্ষেত্রে মৌনং অসম্মতি লক্ষমং!

— সিনেমায় বনানী দেবীর নাচ দেখে চোখ পাকিয়েছে ভায়া, এ সব মেয়ে কি পছন্দ হয়! — কানাইবাবু মনের বিরক্তি মনে চেপে রাখলেন।

পিসিমা বললেন — ছেলের আপত্তি তো হবেই। হা-ঘরের মেয়ে এনে হবে কি ? মহুরী-টুহুরীর সঙ্গে কুটুম্বিতা চলবে না।

সুন্দরী মেয়ে চাই। এইটেই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কৈলাসডাক্তার পাত্রী দেখেছেন আর বিপদের কথা এই যে, তাঁর চোখে অসুন্দর তো কেউ নয়। তাই কৈলাশডাক্তার কাউকে সুন্দরী বলে সার্টিফিকেট দিলেই চলবে না। এ বিষয়ে তাঁর রুচি সম্বন্ধে সকলের যথেষ্ট সংশয় আছে। প্রথম ছেলে, জীবনসঙ্গিনী নিয়ে ঘর করতে হবে যাকে, তারই মতটা গ্রাহ্য। তারপর আর সকলের।

কৈলাসবাবু নিজে কুরূপ। কুত্সা করা যাদের আনন্দ তারা আড়ালে বলে ‘কালো জিভ’ ডাক্তার। ভদ্রলোকের জিভটাও নাকি কালো। যৌবনে এ গঞ্জনা কৈলাস ডাক্তারকে মর্মপীড়া দিয়েছে অনেক। আজ প্রৌঢ়ত্বের শেষ ধাপে এসে সেই পীড়িত মর্মের কোন অভিমান আর নেই।

বাংলোর বারান্দায় সোফায় বসে নির্দিষ্ট মনে কৈলাসডাক্তার এই কথাই ভাবছিলেন। এই রূপতত্ত্ব তাঁর কাছে দুর্বোধ্য। আজ পঁচিশ বছর ধরে যে ঝানু সার্জন ময়নাঘরে মানুষের বুক চিরে দেখে এসেছে, তাকে আর বোঝাতে হবে না, কা’কে সোনার দেহ বলে! মানুষের অন্তরঙ্গ রূপ-এর পরিচয় কৈলাসডাক্তারের মত আর কে জানে! কিন্তু তাঁর এই ভিন জগতের সুন্দরম্, তাকে কদর দেবার মত দ্বিতীয় মানুষ কৈ ? দুঃখ এইটুকু।

হঠাৎ শেকল বাঁধা হাউন্ডটার বিকট চিত্কার আর লাফঝাঁপ। ফটক ঠেলে হুড়মুড় করে ঢুকলো মানুষের ব্যঙ্গমূর্তি কয়েক প্রাণী। যদু ডোম আর নিতাই সহিস দৌড়ে এল লাঠি নিয়ে।

যদু ও নিতাইয়ের গলাধাক্কা গ্রাহ্য না করে ফটকের ওপর জুত করে বসলো একটা ভিখারী পরিবার। নোংরা চটের পোঁটলা, ছেঁড়া মাদুর, উনুন, হাঁড়ি, ক্যানেস্তারা, পিঁপড়ে ও মাছি নিয়ে একটা কদর্য জগতের অংশ। সোরগোল শুনে সবাই বেরিয়ে এল।

কৈলাসবাবু বললেন — কে রে এরা যদু ? চাইছে কি ?

— এ ব্যাটার নাম হাবু বোষ্টম, তাঁতীদের ছেলে। কুষ্ঠ হয়ে ভিক্ষে ধরেছে।

কুষ্ঠী হাবু তার পট্টিবাঁধা হাত দুটো তুলে বললো — কৃপা করো বাবা!

— এই বুড়িটা কে ?

— এ মাগীর নাম হামিদা। জাতে পশ্চিমা বেদিয়া, বসন্তে কানা হবার পর দলছাড়া হয়েছে। ও এখন হাবুরই বৌ।

হামিদা কোলের ভেতর থেকে নেকড়ার জড়ানো দু’মাসের একটা ছেলেকে দু’হাতে তুলে ধরে নকল কান্নায় কঁকিয়ে কঁকিয়ে বললো — বাচ্চাকা জান হুজুর! এক পিয়ালী দুধ হুজুর! এক মুঠঠি দানা হুজুর!

— আর এই ধিঙ্গি ছুঁড়িটা কে? পিসিমা প্রশ্ন করলেন।

— ওর নাম তুলসী। হাবু আর হামিদার মেয়ে।

— আপন মেয়ে।

— হ্যাঁ পিসিমা। যদু উত্তর দিল।

তুলসী একটা কলাই-করা থালা হাতে তুলে চুপ করে বসে আছে। পরিধানে খাটো একটা নোংরা পর্দার- কাপড়, বুকের ওপর থেকে গেরো দিয়ে ঝোলানো। আভরণের মধ্যে একটা কৌড়ির তাবিজ।

দেখবার মতো চেহারা এই তুলসীর! বছর চৌদ্দ বয়স, তবু সর্বাঙ্গে একটা রূঢ় পরিপুষ্টি। ডাকিনীর টেরাকোট্টা মূর্তির মত কালি-মাড়া শরীর। মোটা থ্যাবলা নাক। মাথার বেঢপ খুলিটা যেন একটা চোট লেগে টেরে-বেঁকে গেছে। বড় বড় দাঁত, যেন একটা জন্তুর হিংসে ফুটে রয়েছে। মুখের সমস্ত পেশী ভেঙেচুরে গেছে, ছন্নছাড়া বিক্ষোভে। এ মুখের দিকে তাকিয়ে দাতাকর্ণও দান ভুলে যাবে, গা শিরশির করবে। কিন্তু যদু বললো — তুলসীর ভিক্ষের রোজগারই নাকি এদের পেটভাতের একমাত্র নির্ভর।

হাবু ঠিক ভিক্ষে করতে আসেনি। মিউনিসিপ্যালিটি এদের বস্তি ভেঙে দিয়েছে। নতুন অফিসের গুদাম হবে সেখানে। শহরের এলাকায় এদের থাকবার আর হুকুম নেই।

হাবু কান্নাকাটি করলো — একটা সার্টিফিকেট দিন বাবা। মুচিপাড়ার ভাগাড়ের পেছনে থাকবো। দীননাথের দিব্যি, হাটবাজারে ঘেঁষবো না কখনো। তুলসিই ভিক্ষে খাটবে, ওর তো আর রোগ বালাই নেই।

পিসিমা বললেন — যেতে বল, যেতে বল। গা ঘিন্ ঘিন্ করে। কিছু দিয়ে বিদেয় করে দে রাণু।

রাণু বললো — আমার ছেঁড়া ফ্লানেলের ব্লাউজটা দিয়ে দিই। এই শীতে তবু ছেলেটা বাঁচবে।

— হ্যাঁ দিয়ে দে। থাকে তো একটা ছেঁড়া শাড়িও দিয়ে দে। বয়স হয়েছে মেয়েটার, লজ্জা রাখতে হবে তো।

কৈলাসাডাক্তার বললেন — আচ্ছা যা তোরা। সার্টিফিকেট দেব, কিন্তু খবরদার হাটবাজারে আসিস না।

হাবু তার সংসারপত্র নিয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেলে তুলসীর কথাটাই আলোচনা হলো আর একবার! কৈলাসবাবু হেসে বললেন — দেখলে তো সুন্দরী তুলসীকে! ওরও বিয়ে হয়ে যাবে, জানো ?

ঝি উত্তর দিল — বিয়ে হবে না কেন ? সবই হবে। তবে সেটা আর বিয়ে নয়।

কৈলাসবাবু এক পাত্রী দেখে এসেছেন। নন্দ দত্তের বোন দেবপ্রিয়া। মেয়ে ভালই, তবে সুকুমার একবার দেখে আসুক।

দেখানো হল দেবপ্রিয়াকে। মেদের প্রাচুর্যে বয়স ঠিক ঠাহর হয় না। চওড়া কপাল, ছোট চিবুক, গোল গোল চোখ। গায়ের রঙ মেটে, কিন্তু সুমসৃণ। ভারি ভুরু দু’টোতে যেন তিব্বতী উপত্যকার ধূর্ত একটু ছায়া, প্রচ্ছন্ন এক মঙ্গোলিনীকে ইসারায় ধরিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। সে বোধহয় জানে, তার এই অপ্রাকৃত পৃথুলতা লোক হাসাবার মতোই। দেবপ্রিয়ার গলা মিষ্টি, গান গায় ভাল।

সুকুমার হ্যাঁ না কিছুই বলে না। বলা তার স্বভাব নয়। বোঝা গেল, এ মেয়ে তার পছন্দ নয়।

পিসিমাও বললেন — হবেই না তো পছন্দ। শুধু গলা দিয়েই তো আর সংসার করা যায় না। তা ছাড়া নন্দরা বংশেও খাটো।

কৈলাসডাক্তার দুশ্চিন্তায় পড়লেন। সমস্যা ক্রমেই ঘোরালো হচ্ছে। এ মোটে সহজ ব্যাপার নয়। নানা নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে একে একে। শুধু সুন্দরী হলেই চলবে না। বংশ, বিত্ত, শিক্ষা ও রুচি দেখতে হবে।

মাঝে পড়ে পুরুত ভট্টাচার্য্যি আরও খানিকটা ইন্ধন জুগিয়ে গেছেন। সমস্যাটা ক্রমেই তেতে উঠেছে। ভট্টাচার্য্যি বাড়ির সকলকে বুঝিয়ে গেছেন — নিতান্ত আধ্যাত্মিক এই বিয়ে জিনিসটা। কুলনারীর গুণ-লক্ষণ মিলিয়ে পাত্রী নির্বাচন করতে হবে। গৃহিণী সচিব সখি প্রিয়শিষ্যা, সব যাচাই করে দেখতে হবে। সারাজীবনের ধর্মসাধনার অংশভাগিনী, এ ঠাট্টার ব্যাপার নয়। ধরে বেঁধে একটা নিয়ে এলেই চলবে না। ওসব যাবনিক অনাচার চলবে না।

হ্যাঁ, তবে সুন্দরী হওয়া চাই-ই। কারণ সৌন্দর্য একটা দেবসুলভ গুণ।

এবার যতদূর সম্ভব সাবধানে, খুব ভেবেচিন্তে কৈলাসডাক্তার এক পাত্রী দেখে এলেন। অনাদি সরকারের মেয়ে অনুপমা, সুশিক্ষিতা ও সুন্দরী।

অনুপমার বয়স একটু বেশি। রোগা বা অতিতন্বী দুই-ই বলা যায়। মুখশ্রী আছে কি না আছে তা বিতর্কের বিষয়। তবে চালচলনে সুরুচির আবেদন আছে নিশ্চয়। রূপে যেটুকু ঘাটতি তা পুষিয়ে গেছে সুশিক্ষার হ্লাদিনী গুণে।

প্রতিবাদ করলো রাণু। — না, ম্যাচ হবে না। যা ঝিরকু চেহারা মেয়ের!

ঋষি বালকের মতো কাঁচা মন সুকুমারের। হাঁ — না বলা ধাতে সম্ভব নয়। কিংবা অতিরিক্ত লজ্জা, তাও হতে পারে। তবে তার আচরণেই বোঝা গেল, এ বিয়েতে সে রাজী নয়।

পিসিমা বললেন — ভালই হল। জানি তো, কী কিপটে অনাদি চাষা। বিনাখরচে কাজ সারতে চায়। পাত্র যেন পথে গড়াচ্ছে।

দৈবজ্ঞী মশায় এসে পিসিমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন — পাত্রীর রাশি আর গণ খুব ভাল করে মিলিয়ে দেখবেন পিসিমা। ওসব কোন তুচ্ছ করার জিনিস নয়।

— সবই গ্রহের কৃপা। দৈবাজ্ঞী সুকুমারের কোষ্ঠী বিচার করে বাড়ির সকলকে বড় রকম একটা প্রেরণা দিয়ে চলে গেলেন। — যা দেখেছি তা তো বড়ই ভাল মনে হচ্ছে। পাতকীরিষ্টি আর নেই, এবার কেতুর দশা চলছে। এই বছরের মধ্যেই ইষ্টলাভ। সুন্দরী রামা, রাজপদং, ধনসুখং। আর, আর কত বলবো।

— এই ছুঁড়ি ওখানে কি করছিস ? কৈলাসবাবু ধমকে উঠলেন। সুকুমারের পড়ার ঘরের সামনের বারান্দায় ফুলগাছের টবের কাছে বসে আছে তুলসী। হাতে কলাই-করা থালাটা।

যদু কোত্থেকে এসে একসঙ্গে হুমকি দিল। — ওঠ্ এখান থেকে হারামজাদি! কেমন ঘাপটি মেরে বসে আছে চুরির ফিকিরে।

কৈলাসডাক্তার বললেন — যাক্, গালমন্দ করিস নে। খিড়কির দোরে গিয়ে বসতে বল।

সামনে কানাইবাবুকে পেয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন — কি কানাই ? এবার আমাকে বিড়ম্বনা থেকে একটু রেহাই দেবে কি না ? সুন্দরী পাত্রী জুটলো তোমাদের ?

— আজ্ঞে না! চেষ্টার তো ত্রুটি করছি না।

— চেষ্টা করেও কিছু হবে না। তোমাদের সুন্দরের তো মাথামুণ্ডু কিছু নেই।

— কি রকম ?

— কি রকম আবার ? চুল কালো হলে সুন্দর আর চামড়া কালো হলে কুত্সিত। এই কথাটা কি মহাব্যোমে লেখা আছে, শাশ্বত কালি দিয়ে ?

একটু চুপ করে থেকে কৈলাসডাক্তার বললেন — পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি। ধন্যি বাবা কাশীরাম! একবার ভাব তো কানাই, কোনো ভদ্রলোকের যদি নাক থেকে কান পর্যন্ত ইয়া দুটো চোখ ছড়িয়ে থাকে, কী চীজ হবে সেটা!

কানাইবাবু বললেন — যা বলেছেন। কত যে বাজে সংস্কারের সাত-পাঁচ রয়েছে লোকের। তবে মানুষের রূপের একটা স্টান্ডার্ড অবশ্য আছে। অ্যানথ্রপলজিস্টরা যেমন বলেন....।

— অ্যানথ্রপলজিস্ট না চামড়াওয়ালা। কৈলাসবাবু চড়া মেজাজে বললেন — আসুক একবার আমার সঙ্গে ময়নাঘরে। দুটো লাশের ছাল ছাড়িয়ে দিচ্ছি। চিনে বলুক দেখি, কে ওদের আলপাইন নেগ্রিটো আর কে প্রোটো-অস্ট্রাল। দেখি ওদের বংশ বিদ্যের মুরোদ। মেলা বকো না আমার কাছে।

কানাইবাবু সরে পড়ার পথ দেখলেন।

— জান কানাই, আমাকে আড়ালে সবাই কালোজিভ বলে ডাকে। বর্বর আর গাছে ফলে ? একটা বাজে টাবু ছাড়বার শক্তি নেই, সভ্যতার গর্ব করে! আধুনিক হয়েছে! যত সব ফাজিলের দল!

কৈলাসডাক্তার ক্ষুব্ধ লাল চোখ দুটিকে শান্ত করে চুরুট ধরালেন।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা সত্যদাসের বাড়িতে ভাল এক পাত্রী দেখে খুশি মনে কৈলাসডাক্তার ফিরলেন। ফটকে পা দিয়েই দেখলেন, সুকুমারের পড়ার ঘরের সামনে বসে যদু আর নিতাই তুলসীর সঙ্গে হাসি-মস্করা করছে।

— এই রাস্কেল সব! কি হচ্ছে ওখানে ?

তুলসী ওর থালা হাতে নিয়ে আর দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল। যদু নিতাই আমতা আমতা করে কিছু একটা গুছিয়ে বলতে বৃথা চেষ্টা করে চুপ করে রইল। কৈলাসডাক্তার সুকুমারকে ডেকে বললেন — ঘরের দোর খোলা রাখ কেন ? সেই ভিখিরি ছুঁড়িটা কদিন থকে ঘুরঘুর করছে এদিকে। খুব নজর রাখবে, কখন কি চুরি করে সরে পড়ে, বলা যায় না।

সুকুমারের মা ডেকে কৈলাসবাবু জানালেন — সত্যদাসের মেয়ে মমতাকে দেখে এলাম। একরকম পাকা কথাই দিয়ে এসেছি। এবার সুকুমার আর তোমরা দেখে এস। আমায় আর নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিও না।

যথারীতি মমতাকে দেখে আসা হলো। মমতার রূপে অসাধারণত্ব আছে, সন্দেহ নেই। যেন এক অমাবস্যা কুমারী, ঘুটঘুটে কালো। সমস্ত অবয়বে একটা সুপেশল কাঠিন্য। মণিবদ্ধ ও কনুইয়ের মজবুত হাড় আর হাতপায়ের রোমঘন পারুষ্য পুরুষকে লজ্জা দেয়। চওড়া করোটির ওপর অতিকুঞ্চিত স্থূলতন্তু চুলের ভার, নীলগিরির চূড়ার ওপর মেঘসিতবকের দৃশ্যটা মনে পড়িয়ে দেয়। মূর্তির শিল্পীরা অবশ্য খুশি হয়ে বলবেন, এ যেন এক দৃঢ়া দ্রাবিড়া নায়িকার মূর্তি। মমতার প্রখর দৃষ্টির সামনে সুকুমারই সকুঞ্চিত হল। বরমালা-কাঙাল অবলার দৃষ্টি এ নয়; বরং এক অকুতোলজ্জা স্বয়ংবরার জিজ্ঞাসা যেন জ্বলজ্বল করছে মমতার দুই চোখে।

সত্যবাবু গুণপনার পরিচয় দিলেন — বড় পরিশ্রমী মেয়ে, কারণ স্বাস্থ্য খুব ভাল। ছাত্রীজীবনে প্রতিবছর স্পোর্টসে প্রাইজ পেয়ে এসেছে।

মেয়ে দেখে এসে সুকুমার মুখ ভার করে শুয়ে রইল। রাণু বললো — এ নিশ্চয় রাক্ষসগণ।

পিসিমাও একটু বিমর্ষ হয়ে বললেন — হ্যাঁ, সেই তো কথা। বড় হাট্টাকাট্টা চেহারা। নইলে ভাল বরপণ দিচ্ছিল, দানসামগ্রীও।

তবু কৈলাসডাক্তার তোড়জোড় করছেন। মমতারই সঙ্গে বিয়ে একরকম ঠিক। এবার একটু শক্ত হয়েছেন তিনি। দশজনের দশ কথার চক্রে আর ভূত সাজতে পারবেন না।

কিন্তু যা কখনো হয়নি, তাই হল। সুকুমারের প্রকাশ্য বিদ্রোহ। সুকুমার এবার মুখ খুলেছে। রাণুকে ডেকে নিয়ে জানিয়ে দিয়েছে — সত্যদাসের সঙ্গে গলাগলি দেখেছি বাবার! ওখানে যদি বিয়ে ঠিক হয়, তবে একটু আগেভাগে আমায় জানাবি। আমি যুদ্ধে সার্ভিস নিচ্ছি।

কথাটা শুনে পিসিমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সুকুমারের মা রান্না ছেড়ে বৈঠকখানায় গিয়ে কৈলাসবাবুর সঙ্গে একপ্রস্থ বাকযুদ্ধ সেরে এলেন। কিন্তু ফল হল না কিছুই। কৈলাসবাবু এবার অটল।

সুকুমারের মা কেঁদে ফেললেন — ঐ হদকুচ্ছিত মেয়ের সঙ্গে বিয়ে! তোমার ছেলে ঐ মেয়ের ছায়া মাড়াবে ভেবেছ ? এমন বিয়ে না দিয়ে চিমটে দিয়ে বিদেয় করে দাও না!

কৈলাসবাবুর অটলতার ব্যতিক্রম হল না কিছুই। তিনি শুধু একটা দিন স্থির করার চেষ্টায় রইলেন।

সুকুমার মারমূর্তি হয়ে রাণুকে বললো — সেই দৈবজ্ঞীটা এবার এলে আমায় খবর দিবি তো!

— কোন্ দৈবৈজ্ঞী ?

— ঐ যে বেটা সুন্দরী রামাটামা বলে গিয়েছিল। জিভ উপড়ে ফেলবো ওর।

আড়ালে দাঁড়িয়ে কৈলাসডাক্তার শুনলেন ও বার্তালাপ। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠলো তাঁর! সুকুমারের মাকে ডেকে প্রশ্ন করলেন — কি পেয়েছ ?

শঙ্কিত চোখে কৈলাসবাবুর দিকে তাকিয়ে সুকুমারের মা বললেন — কি হয়েছে ?

— ছেলের বিয়ে দিতে চাও ?

__ কেন দেব না?

— সত্পাত্রী চাও, না সুন্দরী পাত্রী চাও ?

সুকুমারের মা ভেবে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন — সুন্দরী পাত্রী।

— বেশ তবে লিখে দাও আমাকে, সুন্দরী কাকে বলে। তন্বী শ্যামা পক্কবিম্বাধর, আরও যা আছে সব লিখে দাও। আমি সেই ফর্দ মিলিয়ে পাত্রী দেখবো।

এই বিদঘুটে প্রস্তাবে সুকুমারের মা’র মেজাজও ধৈর্য হারাবার উপক্রম করলো। তবু মনের ঝাঁজ চেপে নিয়ে বললেন — তার চেয়ে ভাল, তোমায় পাত্রী দেখতে হবে না, আমরা দেখছি।

— ধন্যবাদ। খুব ভাল কথা। এবার তাহলে আমি দায়মুক্ত।

— হ্যাঁ।

কৈলাসডাক্তার এখন অনেকটা সুস্থির হয়েছেন। হাসপাতালে যান আসেন। রুগী নিয়ে, ময়নাঘরের লাশ নিয়ে দিন কেটে যায়। যেমন আগে কাটতো।

বাগানের দিকে একটা হট্টগোল। কৈলাসডাক্তার এগিয়ে গিয়ে দেখেন, যদুডোম আর নিতাই তুলসীকে ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাগানের ফটক দিয়ে বার করে দিচ্ছে।

— কি ব্যাপার নিতাই ?

— বড় পাজি এই ছুঁড়িটা হুজুর। পয়সা দেয়নি বলে দাদাবাবুর ঘরে ঢিল ছুঁড়ছিল। আর, এই দেখুন আমার হাত কামড়ে দিয়েছে।

কৈলাসডাক্তার বললেন — বড় বাড় বেড়েছে ছুঁড়ির। ভিখিরীর জাত, দয়া করলেই কুকুরের মত মাথায় চড়ে। কেবলই দেখছি মাস তিন চার থেকে শুধু এদিকেই নজর। এবার এলে পুলিশে ধরিয়ে দিবি।

তুলসী ফটকের বাইরে গিয়েও মত্তা বাতুলীর মত আরও কয়েকটা ইটপাকেল ছুঁড়ে চলে গেল। কৈলাসডাক্তার বললেন — সব সময় ফটকে তালা বন্ধ করে রাখবে।

সেদিনই সন্ধ্যেবেলা। অনেক রাতে রুগী দেখে বাড়ি ফিরতেই কৈলাসডাক্তার দেখলেন, ফটক খুলে অন্ধকারে চোরের মত পা টিপে-টিপে সরে পড়ছে তুলসী। কৈলাসবাবুকে দেখে আরও জোরে দৌড়ে পালিয়ে গেল! কৈলাসডাক্তার হাঁক দিতেই যদু ও নিতাই হাজির হল লাঠি হাতে।

অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন — এ কি ? ফটক খোলা, বারান্দার আলো জ্বলছে, সুকুমারের ঘরে আলো, আমার বৈঠকখানা খোলা; তোমরা সব জেগেও রয়েছ, অথচ ছুঁড়িটা বেমালুম চুরি করে সরে পড়লো!

কৈলাসডাক্তার সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে দেখলেন। — আমার ঘরটা সব তছনছ করেছে কে ? টেবিল থেকে নতুন বেলেডোনার শিশিটাই বা গেল কোথায় ?

অনেকক্ষণ বকাবকি করে শান্ত হলেন কৈলাসডাক্তার। কিছু চুরি হয়নি বলেই মনে হল।

পরের দিন। দিনটা আজ ভাল নয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আকাশে দুর্যোগ ঘনিয়ে আছে। কানাইবাবু এসে কৈলাসডাক্তারকে জানালেন — সুন্দরী পাত্রী পাওয়া গেছে। জগৎ ঘোষের মেয়ে। সুকুমারের এবং আর সবারই পছন্দ হয়েছে। বংশে শিক্ষায় ও গুণে কোন ত্রুটি নেই।

কৈলাসডাক্তার বললেন — বুঝলাম, তোমার কল্পতরুর সন্ধান পেয়েছ, সুখবর।

— আপনাকে আজ রাত্রে আশীর্বাদ করতে যেতে হবে।

— তা, যাব।

যদুডোম এসে তখুনি খবর দিলে, তিনটে লাশ এসেছে ময়না তদন্তের জন্য। কৈলাসডাক্তার বললেন — চল রে যদু! এখনি সেরে রাখি। রাত্রে আমার নানা কাজ রয়েছে।

ময়নাঘরে এসে কৈলাসডাক্তার বললেন — বড় মেঘলা করেছে রে। পেট্রোমাক্স বাতি দুটো জ্বেলে দে।

যন্ত্রপাতিগুলো গামলায় সাজিয়ে আস্তিন গুটিয়ে নিয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন — রাত হবে নাকি রে যদু ?

— আজ্ঞে না। দুটো আগুনে পোড়া লাশ, পচে পাঁক হয়ে গেছে। ও তো জানা কেস, আমি চিরে ফেড়ে দেব। বাকি একটা শুধু......।

— নে কোনটা দিবি, দে! কৈলাসডাক্তার করাত হাতে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন।

লাশের ঢাকাটা খুলে ফেলতেই কৈলাসডাক্তার চমকে উঠলেন — অ্যাঁ, এ কে রে যদু ?

যদু ততক্ষণে আলগোছে সরে পড়ে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কৈলাসডাক্তারের প্রশ্নে ফিরে এসে বললো — হ্যাঁ হুজুর, তুলসীই, সেই ভিখিরী মেয়েটা।

কৈলাসডাক্তার বোকার মত যদুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। যদু চটপট হাত চালিয়ে তুলসীর নোংরা শাড়ীটা আর গায়ের ছেঁড়া কোটটা খুলে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। আবার বাইরে যাবার চেষ্টা করতেই কৈলাসডাক্তার বললেন — যাচ্ছিস কোথায় ? স্পিরিট দিয়ে লাশ মোছ ভাল করে। ইউক্যালিপটাসের তেলের বোতলটা দে। কিছু কর্পূর পুড়তে দে, আরও একটা বাতি জ্বাল।

— ওয়ান মোর আনফর্চুনেট!

কথাটার মধ্যে যেন একটু বেদনার আভাস ছিল। তুলসীর লাশে হাত দিলেন কৈলাসডাক্তার।

করাতের দু’পোঁচে খুলিটা দুভাগ করা হল। কৈলাসডাক্তারের হাতের ছুরি ফোঁস ফোঁস করে সনিশ্বাসে নেচে কেটে চললো লাশের উপর। গলাটা চিরে দেওয়া হল। সাঁড়াশি দিয়ে পটপট করে পাঁজরাগুলো উল্টে দিলেন কৈলাসডাক্তার।

যেন ঘুমে ঢলে রয়েছে তুলসীর চোখের পাতা। চিমটে দিয়ে ফাঁক করে কৈলাসডাক্তার দেখলেন, নিশ্চল দু কণীনিকা যেন নিদারুণ কোন অভিমানে নিষ্প্রভ হয়ে আছে। শুকিয়ে কুঁচিয়ে গেছে চোখের শ্বেতপটল। সুজলা অশ্রুশীলা নাড়ীগুলো অতিস্রাবে বিষণ্ণ।

— ইস, মরার সময় মেয়েটা কেঁদেছে খুব। কৈলাসডাক্তার বললেন।

যদু বললো — হ্যাঁ হুজুর, কাঁদবেই তো। সুইসাইড কিনা! করে ফেলে তো ঝোঁকের মাথায়। তারপর খাবি খায়, কাঁদে আর মরে!

— গলা টিপে মারেনি তো কেউ ? কৈলাসডাক্তার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। কৈ কোন আঘাতের চিহ্ন নেই! গুচ্ছ গুচ্ছ অম্লান স্বররজ্জু, শ্বাসবহা নালিটাও তেমনি প্রফুল্ল। অজস্র লালায় পিচ্ছিল সুপুষ্ট গ্রসনিকা।

— এত লালা! মরবার আগে মেয়েটা খেয়েছে খুব পেট ভরে।

— হ্যাঁ হুজুর, ভিখিরি তো খেয়েই মরে।

দেহতত্ত্বের পাকা জহুরী কৈলাসডাক্তার। তাঁকে অবাক করেছে আজ কুত্সিতা এই তুলসী। কত রূপসীর কুলবধূর, কত রূপাজীবা নটীর লাশ পার হয়েছে তাঁর হাত দিয়ে। তিনি দেখেছেন তাদের অন্তরঙ্গ রূপ, ফিকে ফ্যাকাশে ঘেয়ো। তুলসী হার মানিয়েছে সকলকে। অদ্ভূত!

বাতিটা কাছে এগিয়ে নিয়ে কৈলাসডাক্তার তাকিয়ে রইলেন — প্রবাল পুষ্পের মালঞ্চের মত বরাঙ্গের এই প্রকট রূপ, অছদ্ম মানুষের রূপ। এই নবনীতপিণ্ড মস্তিষ্ক, জোড়া শতদলের মত উত্ফুল্ল হৃত্কোষের অলিন্দ আর নিলয়। রেশমী ঝালরের মত শত শত মোলায়েম ঝিল্লী। আনাচে কানাচে যেন রহস্যে ডুব দিয়ে আছে সুসূক্ষ্ম কৈশিক জাল।

কৈলাসডাক্তার তেমনই বিমুগ্ধ হয়ে দেখলেন — থরে বিথরে সাজানো সারি সারি রক্তিম পর্শুকা। বরফের কুচির মত অল্প অল্প মেদের ছিটে। মজ্জাস্থি ঘিরে নেমে গেছে প্রাণদা নীলার প্রবাহিকা।

কৈলাসডাক্তার বাতিটাকে আরো কাছে এগিয়ে নিয়ে আর দু’চোখ অপলক করে দেখতে থাকেন — খণ্ডস্ফটিকের মত পীতাভ ছোট বড় কত গ্রন্থির বীথিকা। প্রশান্ত মুকুটধমনী! সন্ধিতে সন্ধিতে সুপ্রচুর লসিকার বুদ্বুদ। গ্রন্থিক্ষীরে নিষিক্ত অতি অভিরাম এই অংশুপেশীর স্তবক আর তরুণাস্থির সজ্জা ঝাঁপিখোলা রত্মমালার মত আলোয় ঝলমল করে উঠলো।

আবিষ্ট হয়ে গেছেন কৈলাসডাক্তার। কুত্সিতা তুলসীর এই রূপের পরিচয় কে রাখে ? তবুও, এ তিমিরদৃষ্টি হয়তো ঘুচে যাবে একদিন। আগামী কালের কোন প্রেমিক বুঝবে এ রূপের মর্যাদা। নতুন অনুরাগের তাজমহল হয়তো গড়ে উঠবে সেদিন! যাক্.....।

কৈলাসডাক্তার আবার হাতের কাজে মন দিলেন। যদু বললো — এ সবে কোন জখম নেই। হুজুর। পেট দেখুন।

ছুরির ফলার এক আঘাতে দু’ভাগ করা হল পাকস্থলী। এইবার কৈলাসডাক্তার দেখলেন, কোথায় মৃত্যুর কামড়। ক্লোমরসে মাখা একটা অজীর্ণ পিণ্ড — সন্দেহ পাউরুটি আর.....বেলেডোনা।

— মার্ডার!

হাতের ছুরি খসে পড়লো মেঝের ওপর। সে শব্দে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কৈলাসডাক্তার।

উত্তেজনায় বুড়ো কৈলাসডাক্তারের ঘাড়ের রগ ফুলে উঠলো দপ দপ করে। পোখরাজের দানার মত বড় বড় ঘামের ফোঁটা কপাল থেকে ঝরে পড়লো মেঝের ওপর।

হঠাৎ ছফ করে টেবিলের কাছে আবার এগিয়ে এলেন কৈলাসডাক্তার। ছোঁ মেরে কাঁচিটা তুলে নিয়ে তুলসীর তলপেটের দুটো বন্ধনী ছেদ করলেন। নিকেলের চিমটের সুচিক্কণ বাহুপুটে চেপে নিয়ে, স্নেহাক্ত আগ্রহে ধীরে ধীরে টেনে তুলে ধরলেন, পরিশুল্কে ঢাকা সুডৌল সুকোমল একটি পেটিকা। মাতৃত্বের রসে উর্বর, মানব জাতির মাংসল ধরিত্রী। সর্পিল নাড়ীর আলিঙ্গনে ক্লিষ্ট ও কুঞ্চিত, বিষিয়ে নীল হয়ে আছে এক শিশু আশা।

আবেগে কৈলাসডাক্তারের ঠোঁটটা কাঁপছিল থরথর করে। যদু এসে ডাকলো — হুজুর।

ডেকে সাড়া না পেয়ে যদু বাইরে গিয়ে নিতাই সহিসের পাশে বসলো।

নিতাই জিজ্ঞেস করে — এত দেরী কেন রে যদু ?

— শালা বুড়ো নাতির মুখ দেখছে।